ট্রাম্প–রোনালদো মুখোমুখি: কী বললেন সাবেক প্রেসিডেন্ট?

ট্রাম্প–রোনালদো মুখোমুখি: কী বললেন সাবেক প্রেসিডেন্ট?

হোয়াইট হাউসের সোনালি সন্ধ্যায় রোনালদো, ট্রাম্প ও মোহাম্মদ বিন সালমান:

এক নৈশভোজে বিশ্বশক্তির অদৃশ্য সমীকরণ

ওয়াশিংটন ডিসির রাত কখনোই পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয় না। কিন্তু গতকালের রাত যেন অন্যসব রাতকেও ছাপিয়ে গেল—কারণ সেদিন হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুমে ছিল এক এমন সন্ধ্যা, যে সন্ধ্যায় টেবিলের চারপাশে বসেছিল আজকের পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে প্রভাবশালী মুখগুলো।
এখানে রাজনীতি ছিল—কিন্তু শুধু রাজনীতি নয়।
এখানে ব্যবসা ছিল—কিন্তু শুধু ব্যবসা নয়।
এখানে কূটনীতি ছিল—কিন্তু সেই কূটনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল সফট পাওয়ার, খেলাধুলা, প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যতের ক্ষমতার কেন্দ্র।

এই সম্মেলনময় সন্ধ্যার ঠিক কেন্দ্রে ছিলেন তিন জন—
ডোনাল্ড ট্রাম্প
মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো

তাঁদের তিনজনের উপস্থিতি যেন তিনটি ভিন্ন স্রোতের মিলন:

রাজনীতির শক্তি (ট্রাম্প)

তেলের ও ভূরাজনীতির শক্তি (এমবিএস)

সফট পাওয়ার ও বিশ্বজনীন জনপ্রিয়তার শক্তি (রোনালদো)

এ তিন শক্তির মিলনই রাতটিকে রাজনৈতিক অঞ্চলের বাইরে এনে নিয়ে যায় বৈশ্বিক প্রভাবের নতুন মানচিত্রে।

ইস্ট রুমের সাজসজ্জা: সফট পাওয়ার ও হার্ড পাওয়ারের এক মঞ্চ

সোনালি পর্দা, ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি, বিদেশি পতাকা, নিরাপত্তা বলয়ের কঠোরতা—ইস্ট রুম সেই রাতে যেন ইতিহাসের সম্মেলনশালার মতো হয়ে উঠেছিল।
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো কারণে ক্ষমতার কেন্দ্র।

টেসলার ইলন মাস্ক—যিনি ভবিষ্যতের গাড়ি, রকেট, স্যাটেলাইটের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করছেন।
অ্যাপলের টিম কুক—প্রযুক্তির এমন একজন মুখ, যার ফোন পৃথিবীর কোটি মানুষের হাতে।
বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীগণ—যারা বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেন।

আর তাঁদের এক পাশে ছিলেন এমন একজন, যিনি মাঠ ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় কথা বলেন খুব কম—তবে উপস্থিতিই যাঁকে আলাদা আলোয় আলোকিত করে। তিনি রোনালদো।

রোনালদো কেন সামনে?

মধ্যপ্রাচ্যে স্পোর্টস ডিপ্লোমেসির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ এখন সৌদি আরব। সেই দেশের ক্রীড়ার মুখ হলো রোনালদো।
তাই তাঁকে সামনে বসানো মানে—
সৌদি–যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্বের ওপর সফট পাওয়ারের সিলমোহর।

এক অর্থে তিনি মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য যা করছেন, তা কোনো মন্ত্রীও করতে পারেন না—কারণ তাঁর প্রভাব মহাদেশ–পেরোনো।

ট্রাম্পের বক্তৃতায় ব্যারন–রোনালদো প্রসঙ্গ:

রাজনৈতিক কৌশল নাকি মানবিক মুহূর্ত?

ট্রাম্প যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, হঠাৎ হেসে রোনালদোর দিকে তাকিয়ে বললেন—
“আমার ছেলে ব্যারন রোনালদোর বিশাল ভক্ত। আজ তার স্বপ্ন পূরণ হলো। এখন মনে হচ্ছে, সে আমাকে একটু বেশি সম্মান করছে!”

এই মন্তব্যে পুরো হলরুম হেসে ওঠে।
কিন্তু এই ছোট বাক্যের পেছনে লুকিয়ে আছে বড় রাজনৈতিক সংকেত:

 ট্রাম্প জানেন জনসাধারণ তারকা–সংযোগ পছন্দ করে

তিনি সবসময় তারকাদের পাশে দাঁড়ান—এটি তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। মানুষের প্রিয় তারকার সঙ্গে বন্ধুত্ব দেখিয়ে তিনি নিজের ব্যক্তিত্বকে আরও জনবান্ধব বানাতে পারেন।

রোনালদোর জনপ্রিয়তা মধ্যপ্রাচ্যেও ট্রাম্পকে লাভ দিতে পারে

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, ব্যবসায়িক বিনিয়োগ এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নীতি নির্ধারণে ট্রাম্প যদি আবার ক্ষমতায় আসেন, রোনালদোর মতো নাম তাঁর জন্য সেতুবন্ধ হতে পারে।

ব্যারনের মাধ্যমে তিনি দেখালেন তিনি ‘ফ্যামিলি–ম্যান’

এটি ভোটারদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক বার্তা—ট্রাম্প শুধু কঠোর রাজনৈতিক নেতা নন; তিনি একজন বাবা, যার সন্তানও মানুষের মতো তারকাদের ফ্যান।

মোহাম্মদ বিন সালমানের সফর: কূটনৈতিক শীতের পর উষ্ণ বসন্ত

২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি নেতৃত্বের প্রতি তীব্র চাপ ও সমালোচনা তৈরি হয়েছিল।
এমবিএস কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র সফর করেননি—কূটনৈতিক বরফ তখন জমে ছিল শক্তভাবে।

কিন্তু এখন—
বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য পাল্টেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি–পরিবর্তন ঘটছে।
চীন–রাশিয়া–মধ্যপ্রাচ্য জোট শক্তিশালী হচ্ছে।

সেই বাস্তবতায় এমবিএস-এর এই সফর শুধু সৌজন্য নয়—এটি
নতুন কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা।

এই নৈশভোজ ছিল সেই পুনরায় উষ্ণ সম্পর্কের বড় ঘোষণা।

রোনালদোর ভূমিকা: ‘সফট পাওয়ার এম্বাসেডর’

রোনালদো এখন শুধু একজন ফুটবল তারকা নন। তিনি সৌদি আরবের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিনিয়োগের এক অঘোষিত রাষ্ট্রদূত।

তাঁর সৌদি লিগে যোগদানের পর লিগের সম্প্রচার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে

তিনি সৌদি বিনিয়োগের মানবিক মুখ

তাঁর জনপ্রিয়তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মনোযোগ টানে

তাঁর ছবি, সাক্ষাৎকার, জার্সি—সবই দেশের সফট পাওয়ারকে বহুগুণে বাড়ায়

তাঁকে হোয়াইট হাউসে থাকা মানে ছিল সৌদি আরবের উপস্থিতিকে আরও কোমল, আরও জনপ্রিয়ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা।

২০২৬ বিশ্বকাপ: রোনালদোর শেষ নাচ, আর ট্রাম্পের বড় স্বপ্ন

২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হবে ফুটবলের সবচেয়ে বড় শক্তি–মহাযজ্ঞ।
ট্রাম্প চান এটি তাঁর প্রেসিডেন্সি (অথবা উত্তরাধিকার) যুগের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক আয়োজন হোক।

রোনালদোর জন্যও ২০২৬ হতে পারে বিদায় বিশ্বকাপ।
এটি তাঁর ক্যারিয়ারের ‘শেষ অধ্যায়’।
তাই যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর এই সফরকে অনেকেই ভবিষ্যতের বিশ্বকাপ রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখছেন।

ব্যবসা, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা—সবকিছুর ছেদবিন্দু ছিল এই নৈশভোজ
এখানে ছিল—

বৈশ্বিক এআই নীতিনির্ধারক

প্রযুক্তি কোম্পানির রাজা

তেলনির্ভর বিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকারী

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কৌশলবিদ

ক্রীড়াজগতের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্ব

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি

এ যেন সেই জায়গা—যেখানে এক সন্ধ্যায় পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এক নৈশভোজে তিন শক্তির মিলন—এটাই ভবিষ্যতের বিশ্বরাজনীতি

এই সন্ধ্যা দেখিয়েছে—
বিশ্বরাজনীতি আর শুধু ক্ষমতার খেলা নয়।
এটি জনপ্রিয়তা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, খেলাধুলা—সবকিছুর মিশ্রণ।

আজকের বিশ্বে

একদিকে ট্রাম্পের হার্ড পাওয়ার

অন্যদিকে এমবিএস-এর জ্বালানি–ভূরাজনীতি

আর তৃতীয়দিকে রোনালদোর সফট পাওয়ার
একসঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন ধরনের শক্তি তৈরি করছে।

এই শক্তিই ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে।

এ কারণেই হোয়াইট হাউসের সেই রাত শুধু এক সন্ধ্যা নয়—
এটি ছিল পরবর্তী দশকের আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারণাপত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *