টনসিল সমস্যা: লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা

টনসিল সমস্যা: লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা

টনসিল সমস্যা: কারণ, উপসর্গ, জটিলতা ও আধুনিক চিকিৎসা

টনসিল আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার (ইমিউন সিস্টেম) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গলার ভেতরের দুই পাশে দুটি মাংসল অংশই হলো টনসিল। এটি মূলত জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরের প্রাথমিক প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। তবে অনেক সময় এই টনসিলই সংক্রমিত হয়ে যায়, তখনই হয় টনসিলাইটিস (Tonsillitis)।

শিশুদের মধ্যে টনসিলের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কারণ, তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠে না। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে এটি সাধারণ একটি সমস্যা। ধুলাবালি, দূষণ, ঠান্ডা পানি, অপরিষ্কার পরিবেশ, এমনকি সংক্রমিত কারও সংস্পর্শে এলেও টনসিল প্রদাহ হতে পারে।

অনেকে মনে করেন টনসিল অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ। কিন্তু আসলে তা নয়।

টনসিলের প্রধান কাজ হলো—

মুখ ও গলার মাধ্যমে প্রবেশ করা জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করা,

রোগপ্রতিরোধের অ্যান্টিবডি তৈরি করা,

শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা।

তবে যখন এই টনসিল বারবার সংক্রমিত হয়, তখন সেটি শরীরের জন্য বরং ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

টনসিল প্রদাহের কারণ

 ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ:
সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো স্ট্রেপটোকক্কাস (Streptococcus pyogenes) নামের ব্যাকটেরিয়া।

ভাইরাস সংক্রমণ:
ফ্লু, অ্যাডেনোভাইরাস, বা এপস্টেইন-বার ভাইরাসও টনসিল প্রদাহ ঘটাতে পারে।

পরিবেশ ও অভ্যাস:
অতিরিক্ত ঠান্ডা পানীয়, ধূমপান, ধুলোবালি, অ্যালার্জি ও অপর্যাপ্ত বিশ্রাম টনসিলকে দুর্বল করে তোলে।

 অন্য রোগের প্রভাবে:
সাইনাস ইনফেকশন বা গলা-নাকের অন্য প্রদাহ থেকেও টনসিল সংক্রমিত হতে পারে।

টনসিলাইটিসের উপসর্গ

গলায় তীব্র ব্যথা

খাবার গিলতে বা কথা বলতে কষ্ট

জ্বর ও ঠান্ডা লাগা

টনসিলের চারপাশে লালচে ফোলা ভাব

গলায় বা চোয়ালের নিচে গাঁট (লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া)

মুখে দুর্গন্ধ

কানে ব্যথা বা চাপ অনুভব

শিশুদের ক্ষেত্রে খাওয়ার অনীহা ও অতিরিক্ত কান্না

যদি সংক্রমণ তীব্র হয়, টনসিলের উপর সাদা বা হলুদ আবরণও দেখা দিতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি টনসিল প্রদাহের ক্ষতি

যদি কেউ বছরে বহুবার টনসিল সংক্রমণে আক্রান্ত হন, তাকে ক্রনিক টনসিলাইটিস (Chronic Tonsillitis) বলা হয়। দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহে টনসিলের টিস্যু স্থায়ীভাবে বড় হয়ে যায়।

এতে দেখা দিতে পারে—

শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বিশেষত রাতে

ঘুমের সময় নাক ডাকা ও ঘুমের ব্যাঘাত (Sleep Apnea)

রিউমেটিক ফিভার, যা হৃদপিণ্ডে ক্ষতি করতে পারে

কিডনি প্রদাহ বা Glomerulonephritis

শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা

মুখের দুর্গন্ধ ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া

শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো তাদের শিক্ষাজীবনেও প্রভাব ফেলে—স্কুল কামাই, মনোযোগের ঘাটতি, দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যা তৈরি করে।

কখন অস্ত্রোপচার প্রয়োজন?

সাধারণ টনসিল সংক্রমণ সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক ও গার্গল দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়।

অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি:

বছরে চার-পাঁচবারের বেশি টনসিল সংক্রমণ

দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক টনসিলাইটিস

টনসিল এত বড় যে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়

রাতে ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া

টনসিলে ফোড়া বা পুঁজ জমা হওয়া

এক দিকের টনসিল হঠাৎ বড় হয়ে ক্যানসারের সন্দেহ হওয়া

টনসিলে টিবি বা অন্য গুরুতর সংক্রমণ ধরা পড়া

টনসিল অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি

বর্তমানে টনসিলেকটমি করার বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতি আছে। প্রতিটি পদ্ধতিরই কিছু সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ডিসেকশন মেথড (Dissection Method)

এটি সবচেয়ে পুরোনো ও প্রচলিত পদ্ধতি। এতে টনসিলকে স্ক্যালপেল দিয়ে কেটে ফেলা হয়। কিছু রক্তপাত হয়, তাই রক্তনালি সেলাই দিতে হয়।

 ইলেকট্রোকটারি (Electrocautery)

এ পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক তাপ ব্যবহার করে টনসিল কাটা হয়। রক্তপাত কম হয়, তবে কিছুটা জ্বালাপোড়া থাকতে পারে।

 লেজার টনসিলেকটমি

লেজার রশ্মির সাহায্যে টনসিল কেটে ফেলা হয়। রক্তপাত কম, সময়ও কম লাগে। তবে এটি ব্যয়বহুল ও প্রশিক্ষিত সার্জনের প্রয়োজন হয়।

কোবলেশন (Coblation) টনসিলেকটমি

এটি বর্তমানে সবচেয়ে উন্নত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। এখানে প্লাজমা এনার্জি ব্যবহার করে টিস্যু নরমভাবে কেটে ফেলা হয়।
এর বৈশিষ্ট্য—

রক্তপাত প্রায় নেই

ব্যথা তুলনামূলক কম

আশপাশের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না

রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন

সকালে অপারেশন হলে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা সম্ভব

আলট্রাসনিক পদ্ধতি

উচ্চ কম্পাঙ্কের কম্পনের মাধ্যমে টনসিল কাটা হয়। অত্যন্ত নিখুঁত পদ্ধতি হলেও দক্ষ সার্জনের প্রয়োজন হয়।

কোবলেশন টনসিলেকটমির বাড়তি সুবিধা

বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক হাসপাতালেই কোবলেশন পদ্ধতিতে টনসিল সার্জারি করা হচ্ছে। এটি বিশেষত শিশুদের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক।

এর সুবিধাগুলো হলো—

অপারেশনের সময় ও পরে রক্তপাত নেই

সেলাই লাগে না

ব্যথা কম

রোগী দ্রুত খেতে পারেন

সংক্রমণের ঝুঁকি কম

হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন কম

দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব

অস্ত্রোপচারের পর যত্ন

অপারেশনের পর কয়েক দিন গলায় হালকা ব্যথা ও গিলতে কষ্ট হতে পারে, যা স্বাভাবিক। চিকিৎসকের পরামর্শমতো অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক খেতে হবে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ—

প্রথম কয়েক দিন ঠান্ডা ও নরম খাবার (দুধ, জুস, আইসক্রিম, পুডিং) খাওয়া ভালো

গরম, ঝাল, শক্ত বা টক খাবার এড়িয়ে চলা

প্রচুর পানি পান করা

ধূমপান ও ধুলাবালি থেকে দূরে থাকা

বিশ্রাম নেওয়া এবং মুখ পরিষ্কার রাখা

সঠিকভাবে যত্ন নিলে কয়েক দিনের মধ্যেই রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যান।

চিকিৎসকের পরামর্শ

গলায় বারবার ব্যথা হলে বা শিশুর নাক ডাকার সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে ইএনটি (ENT) বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। অনেক সময় টনসিলের আড়ালে অন্য জটিল রোগও লুকিয়ে থাকতে পারে।

নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া বা ঘরোয়া চিকিৎসায় ভরসা না করে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানই সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।

শেষ কথা

টনসিলের প্রদাহকে অবহেলা করলে তা ধীরে ধীরে বড় সমস্যায় রূপ নিতে পারে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা ও প্রয়োজন হলে আধুনিক অস্ত্রোপচার করানোই সবচেয়ে কার্যকর সমাধান।
বর্তমানে বাংলাদেশে দক্ষ সার্জন, উন্নত যন্ত্রপাতি এবং নিরাপদ কোবলেশন পদ্ধতির মাধ্যমে টনসিল চিকিৎসা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক সহজ, স্বল্পব্যয়ী ও আরামদায়ক হয়ে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *