রাতেই ধরা পড়ে লিভারের জটিলতা—জানাচ্ছে গবেষণা

রাতেই ধরা পড়ে লিভারের জটিলতা—জানাচ্ছে গবেষণা

রাতে লিভারের জটিলতা: ঘুমের সমস্যা থেকেই বুঝে ফেলুন বিপদ সংকেত

আমাদের শরীরের ভেতরে নিঃশব্দে কাজ করে চলা অঙ্গগুলোর মধ্যে লিভার বা যকৃত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু খাবার হজমে নয়, বরং শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়া, শক্তি উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ, এমনকি হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। বলা হয়, সুস্থ লিভার মানেই সুস্থ শরীর। কিন্তু এই লিভার যখন ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে, তখন এর প্রভাব দেখা দেয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা জায়গায়—বিশেষ করে রাতে ঘুমের মধ্যে।

গবেষণা কী বলছে

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লিভার সিরোসিস বা গুরুতর লিভার রোগে আক্রান্ত অনেক মানুষই ঘুমের ব্যাঘাতে ভোগেন। তাঁরা ঘুমাতে দেরি করেন, মাঝরাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়, সকালে ক্লান্ত অনুভব করেন, এমনকি দিনের বেলাও অতিরিক্ত ঘুমঘুম ভাব অনুভব করেন।

গবেষণাটি আরও জানায়, ঘুমের এই পরিবর্তন শুধু লিভারের দুর্বলতার ফল নয়, বরং হেপাটিক এনসেফ্যালোপ্যাথি (Hepatic Encephalopathy) নামের এক জটিল অবস্থার কারণেও ঘটে। এটি এমন এক মানসিক সমস্যা, যা দেখা দেয় যখন লিভার শরীরের বিষাক্ত উপাদানগুলো বের করে দিতে ব্যর্থ হয়। তখন সেই বিষাক্ত পদার্থগুলো রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে ঘুমের চক্রসহ মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করে।

লিভার ও ঘুমের সংযোগ

আমাদের শরীরে ঘুম নিয়ন্ত্রণে রাখে মেলাটোনিন নামের একটি হরমোন। এটি মস্তিষ্কের দেহঘড়িকে জানায় কখন ঘুমাতে হবে, কখন জাগতে হবে। সুস্থ লিভার এই হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। কিন্তু যখন লিভার বিকল হতে শুরু করে, তখন শরীরে মেলাটোনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে ঘুমের সময়ের সঙ্গে শরীরের তাল কেটে যায়—রাতে ঘুম আসে না, আবার দিনে অকারণে তন্দ্রা আসে।

এছাড়া, লিভারের সমস্যায় রক্তে গ্লুকোজের তারতম্য, শরীরের তাপমাত্রা ও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, যা ঘুমকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

লিভারের সমস্যায় ঘুমে যেসব পরিবর্তন দেখা দেয়

ঘুমাতে দেরি হওয়া বা ইনসমনিয়া

মাঝরাতে বারবার জেগে ওঠা

পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া বা ঘুমের মান খারাপ হওয়া

দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব

রাত-দিনের ঘুমের চক্র উল্টে যাওয়া (রাতে জেগে থাকা, দিনে ঘুমানো)

এই পরিবর্তনগুলোকে সাধারণ ক্লান্তি বা মানসিক চাপ ভেবে অনেকেই অবহেলা করেন। কিন্তু বাস্তবে এগুলো হতে পারে লিভারের জটিলতার প্রাথমিক ইঙ্গিত।

ঘুমের সমস্যা থেকে মানসিক জটিলতা

ঘুমের ব্যাঘাত শুধু ক্লান্তি বা বিরক্তির কারণ নয়। লিভার যখন শরীরের টক্সিন ঠিকমতো ছেঁকে দিতে পারে না, তখন রক্তে অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান জমে মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। এর ফলে দেখা দিতে পারে—

মনোযোগের ঘাটতি

স্মৃতিশক্তি হ্রাস

মেজাজের পরিবর্তন

আচরণে অস্বাভাবিকতা

এমনকি গুরুতর পর্যায়ে কোমা পর্যন্ত

এই অবস্থাই হলো হেপাটিক এনসেফ্যালোপ্যাথি, যা দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগের সবচেয়ে ভয়াবহ জটিলতা হিসেবে বিবেচিত।

কেন রাতে সমস্যা বেশি প্রকট হয়

গবেষণায় দেখা গেছে, লিভারের অনেক জৈবিক কার্যক্রম মূলত রাতের সময় ঘটে। রাতে শরীর যখন বিশ্রামে থাকে, তখন লিভার টক্সিন অপসারণ, গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ও হরমোন সমন্বয়ের কাজ করে। কিন্তু লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই প্রক্রিয়াগুলো ব্যাহত হয়, ফলে রাতে শরীরে অস্বস্তি, অনিদ্রা ও মানসিক অস্থিরতা বেড়ে যায়।

এ ছাড়া, রাতের খাবারে অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে লিভারের ওপর চাপ পড়ে, যা ঘুমের মান আরও খারাপ করে দেয়।

কীভাবে বুঝবেন লিভারের কারণে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে

আপনি নিয়মিত ক্লান্ত অনুভব করছেন, অথচ পর্যাপ্ত ঘুম নিচ্ছেন।

রাতে ঘুম এলেও মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়।

সকালে ঘুম থেকে উঠেও সতেজ লাগে না।

ঘুমের পাশাপাশি হজমে সমস্যা, ত্বক বা চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, পেট ফেঁপে থাকা বা মলমূত্রের রঙে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

এই উপসর্গগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

ভালো ঘুম ও লিভারের যত্নের সহজ উপায়

নিয়মিত ঘুমের সময় ঠিক রাখুন – প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান ও উঠুন।

রাতে ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন – তৈলাক্ত, ভাজা ও অ্যালকোহল জাতীয় খাবার লিভারের ওপর চাপ বাড়ায়।

মোবাইল ও টিভি ব্যবহার সীমিত করুন – শোয়ার অন্তত এক ঘণ্টা আগে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন, কারণ নীল আলো মেলাটোনিন নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটায়।

ঘর রাখুন অন্ধকার ও নীরব – শান্ত পরিবেশ ঘুমের মান বাড়ায়।

পানি পর্যাপ্ত পান করুন – টক্সিন বের করতে সহায়তা করে।

হালকা ব্যায়াম ও ধ্যান – রক্তসঞ্চালন উন্নত করে এবং মানসিক প্রশান্তি আনে।

সবশেষে, যদি ঘুমের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা সঙ্গে অন্য শারীরিক লক্ষণ দেখা দেয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ ঘুমের ব্যাঘাত অনেক সময় শুধু মানসিক চাপ নয়, লিভারের গভীর সংকটের প্রথম সতর্কবার্তা হতে পারে।

শেষকথা

ভালো ঘুম শুধু আরাম নয়, এটি শরীরের প্রতিটি অঙ্গের পুনর্জীবনের সময়। আর লিভার সেই পুনর্জীবনের মূল চালক। তাই ঘুমের ধরনে পরিবর্তন এলে সেটিকে অবহেলা না করে কারণ খুঁজে দেখা উচিত। নিয়মিত জীবনযাপন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও সচেতনতা—এই তিনটিই লিভার ও মস্তিষ্ক দুটোকেই রাখবে সুস্থ ও কার্যকর।

মনে রাখবেন: সুস্থ লিভার মানেই শান্ত ঘুম, আর শান্ত ঘুম মানেই সুস্থ জীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *