সময়ের সীমানা ছাড়ানো সালমান শাহ: ঢালিউডের চিরতরুণ ফ্যাশন কিং
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কিছু নাম সময়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়।
সেই তালিকার প্রথম সারিতে অনায়াসে উঠে আসে একটাই নাম—সালমান শাহ।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬—মাত্র তিন বছরের ক্যারিয়ার। কিন্তু এই তিন বছরেই তিনি বদলে দিয়েছেন ঢালিউডের সংজ্ঞা, দর্শকের চোখে নায়কের সংজ্ঞা, আর তরুণদের চোখে ফ্যাশনের সংজ্ঞা।
আজ তাঁর মৃত্যুর ২৯ বছর পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ছবির নিচে হাজারো মন্তব্যে দেখা যায়—
“তুমি আজও জীবন্ত, সালমান ভাই।”
এ যেন এক অনন্ত উপস্থিতি, যা সময়ের গতিও মুছে ফেলতে পারেনি।
প্রথম আবির্ভাব: এক ঝলক আলো
১৯৯৩ সালের ‘কে তোমাকে ভালোবাসে’ ছবিতে প্রথম পর্দায় আসেন সালমান শাহ।
এক তরুণ নায়ক—চুলে হালকা ব্যাকব্রাশ, সাদা টি-শার্ট, ডেনিম জিনস, চোখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি।
দর্শক স্তব্ধ।
তখনকার সময়ের বাংলা সিনেমা মানেই—অতিরঞ্জিত সংলাপ, ভারী পোশাক, অতিরিক্ত আবেগ।
সেই জায়গায় এসে সালমান দেখালেন, একজন নায়কও হতে পারেন আধুনিক, স্মার্ট ও স্বাভাবিক।
তিনি যেন ছিলেন নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশের যুবসমাজের প্রতিচ্ছবি—
যে প্রজন্ম শহরে উঠতে শুরু করেছে, কলেজে নতুন চিন্তা করছে, পোশাকে খুঁজছে নিজের রুচি।
তাই সালমান শাহ হয়ে উঠলেন তাদেরই প্রতিনিধি, তাদেরই কণ্ঠস্বর।
ফ্যাশনে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ
সালমান শাহ বিশ্বাস করতেন, ফ্যাশন মানে কেবল পোশাক নয়;
বরং ফ্যাশন মানে নিজেকে উপস্থাপনের শিল্প।
তাঁর পোশাকে কখনো ছিল না বাড়াবাড়ি, ছিল শুধু পরিমিত রুচি।
তিনি জানতেন, রঙ, কাট আর ফিট—এই তিনটি বিষয় ঠিক থাকলেই একটা সাধারণ পোশাকও হয়ে উঠতে পারে ব্যক্তিত্বের প্রতীক।
তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল নিউট্রাল শেডের পোশাক—সাদা, ধূসর, নেভি, কালো।
তাঁর জিনস ছিল হালকা ওয়াশড, শার্ট ছিল ওপেন কলার, স্নিকার্স ছিল কনভার্স বা লোফার।
সিনেমায় যেমন তিনি দেখিয়েছেন রোমান্সের এক নতুন ধারা, তেমনি ফ্যাশনেও দেখিয়েছেন আত্মবিশ্বাসের নতুন সংজ্ঞা।
ব্যাকব্রাশ চুল ও ব্যান্ডানার বিপ্লব
যদি ৯০–এর দশকে বাংলাদেশের কোনো নরসুন্দরের দোকানে যাওয়া যেত, দেখা যেত এক অদ্ভুত দৃশ্য।
তরুণেরা একটাই কথা বলছে—
“ভাই, চুলটা সালমান শাহ স্টাইলে কাটবেন।”
তাঁর ব্যাকব্রাশ হেয়ারস্টাইল তখন ছিল জাতীয় ট্রেন্ড।
এমনকি তিনি যেসব ছবিতে ব্যান্ডানা পরেছেন (‘বিচার হবে’, ‘প্রেমযুদ্ধ’, ‘বিক্ষোভ’)—তার পরেই বাজারে ব্যান্ডানার বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ।
নেপালি টুপি, মধ্যপ্রাচ্যের রুমাল—সবকিছুই তিনি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন নিজের ব্যবহার দিয়ে।
তাঁর চুল, তাঁর হাসি, তাঁর দৃষ্টি—সবকিছুতেই ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ।
তাঁর স্টাইল ছিল এমন যে, দর্শক তাঁকে অনুকরণ করতে চাইলেও পুরোপুরি পারেনি।
নিজেই নিজের স্টাইল ডিরেক্টর
আজকের দিনে একজন তারকার পেছনে কাজ করে এক বিশাল টিম—স্টাইলিস্ট, মেকআপ আর্টিস্ট, ডিজাইনার, ফটোগ্রাফার।
কিন্তু নব্বইয়ের সেই সময়ে এসব ছিল না।
আর সালমান শাহর প্রয়োজনও ছিল না—কারণ তিনি নিজেই ছিলেন নিজের স্টাইল ডিরেক্টর।
তাঁর সঙ্গে কাজ করা পরিচালকরা প্রায়ই বলতেন,
“সালমানকে কখনো পোশাক দিতে হতো না। সে নিজেই ঠিক করত কী পরবে।”
শুটিংয়ের আগের দিন তিনি ঘুরে বেড়াতেন নিউমার্কেট, গাউছিয়া, বায়তুল মোকাররমে।
নিজে কাপড় কিনতেন, টেইলরের পাশে বসে নির্দেশ দিতেন—
‘এই সেলাইটা এখানে, কলারটা একটু ছোট হবে, বোতাম কালো নয়—সাদা।’
কতটা নিখুঁত চোখ, কতটা দায়িত্ববোধ থাকলে একজন অভিনেতা নিজের পোশাকের ডিজাইন পর্যন্ত এত মনোযোগ দিয়ে করেন!
আর সেখানেই সালমান শাহ ছিলেন আলাদা।
জুতা, ঘড়ি ও অনুষঙ্গ: প্রতিটি দৃশ্যে নিখুঁততা
তাঁর পোশাকের মতোই অনুষঙ্গেও ছিল অসাধারণ যত্ন।
জুতা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
তিনি বলতেন,
“একজন পুরুষের রুচি বোঝা যায় তার জুতায়।”
তাঁর সংগ্রহে ছিল শত শত জোড়া জুতা—লোফার, কনভার্স, বুট, স্নিকার্স, ফরমাল অক্সফোর্ড—সবকিছু।
দেশের বাইরে গেলেই ফিরতেন নতুন নতুন জুতা নিয়ে।
পরিচালকরা জানিয়েছেন, প্রতিটি দৃশ্যে তিনি আলাদা জুতা ব্যবহার করতেন।
ঘড়ির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম।
অন্যরা বাঁ হাতে ঘড়ি পরলেও তিনি সব সময় ডান হাতে পরতেন।
তাঁর হাতে থাকত রাডো, টাইটান, সিটিজেন—লাক্সারি ব্র্যান্ডের সংগ্রহ।
যেদিন মারা যান, সেদিনও তাঁর হাতে ছিল দেড় লাখ টাকা দামের রাডো ঘড়ি।
তাঁর কানে এক পাথরের স্টাড, গলায় সোনার চেইন, হাতে ব্রেসলেট—সব মিলিয়ে এক চিরতরুণ রুচিশীলতা।
ফ্যাশন মানেই চরিত্রের প্রকাশ
সালমান শাহর ফ্যাশনকে শুধু “স্টাইল” বললে ভুল হবে।
তিনি পোশাককে দেখতেন চরিত্রের ভাষা হিসেবে।
কোন দৃশ্যে কী রঙ মানাবে, কোন পরিবেশে কোন পোশাক পরা উচিত—সব কিছুই তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাবতেন।
‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমায় তাঁর টি-শার্ট-জিনসের সহজ লুক যেমন কলেজের রোমান্টিক তরুণকে জীবন্ত করেছিল,
তেমনি ‘স্বপ্নের ঠিকানা’য় তাঁর ফরমাল স্যুটের পরিমিত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছিল একজন পরিপক্ব প্রেমিককে।
তাঁর পোশাক কখনো কৃত্রিম লাগেনি;
কারণ তিনি বুঝতেন, স্টাইল কখনো আলাদা করে চোখে পড়ার জন্য নয়, বরং চরিত্রের অংশ হয়ে ওঠার জন্য।
ফ্যাশনের মাধ্যমে সময়ের আগেই পৌঁছে যাওয়া
সালমান শাহ ৯০–এর দশকে এমন পোশাক পরতেন, যা তখন বাংলাদেশের তরুণদের কল্পনাতেও ছিল না।
ডেনিম জ্যাকেট, হালকা রঙের জিনস, সাদা স্নিকার্স, সানগ্লাস—সব মিলিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন এক গ্লোবাল ফ্যাশন সেন্স।
আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেভাবে তরুণরা স্টাইল অনুকরণ করে,
তখন সেটি হতো সিনেমার পর্দা দেখে।
একটি ছবিতে সালমানের পোশাক দেখেই বাজারে বিক্রি বেড়ে যেত সেই ধাঁচের জামা।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সত্যিকারের স্টাইল আইকন,
যিনি প্রমাণ করেছিলেন—ফ্যাশন মানে দেশের সীমানা মানে না।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে, মৃত্যুর পরও অমলিন
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর—একটা তারিখ, যা লাখো ভক্তের হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত হয়ে আছে।
সেদিন পৃথিবী হারায় এক তরুণ প্রতিভা;
ঢালিউড হারায় তার সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকাকে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা কখনো কমেনি।
ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম—সবখানে এখনো ভেসে বেড়ায় তাঁর সংলাপ, হাসি, ছবির দৃশ্য।
তাঁর ভক্তরা বলেন—
“সালমান মারা যাননি, তিনি কেবল আকাশে চলে গেছেন।”
এখনও নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণ তাঁর ছবি দেখে স্টাইল শেখে।
তাঁরা জানে না, নব্বইয়ের সেই সময়েও এক নায়ক এমনভাবে দেশকে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন।
সালমান শাহ: এক যুগের রুচির প্রতিচ্ছবি
সালমান শাহ কেবল একজন অভিনেতা ছিলেন না—তিনি ছিলেন একটি প্রজন্মের জীবনবোধ।
তাঁর পোশাকে যেমন ছিল ফ্যাশনের বার্তা, তেমনি ছিল আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রেম ও ব্যক্তিত্বের সাহস।
তিনি প্রমাণ করে গেছেন, একজন মানুষ সাধারণ পোশাকেও হয়ে উঠতে পারেন অসাধারণ—
যদি তার মধ্যে থাকে রুচি, সততা আর নিজেকে উপস্থাপনের সাহস।
আজ তাঁর নাম উচ্চারণ মানেই স্মার্টনেসের প্রতীক, ফ্যাশনের প্রতীক, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।