কণ্ঠনালির ক্যানসার: কারণ, লক্ষণ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
কণ্ঠনালি বা স্বরযন্ত্র আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি শুধু কথা বলার জন্য নয়, শ্বাস-প্রশ্বাস ও গলার বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথেও সম্পর্কিত। কিন্তু নানা কারণে এই কণ্ঠনালিতে ক্যানসার হতে পারে, যা সঠিক সময়ে শনাক্ত না হলে প্রাণঘাতী হতে পারে। বিশ্বব্যাপী কণ্ঠনালির ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ ধূমপান, আর বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে এর ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।
কণ্ঠনালির ক্যানসারের কারণ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০–৮৫ শতাংশ কণ্ঠনালির ক্যানসার রোগী ধূমপায়ী। ধূমপান ছাড়াও আরও কিছু ঝুঁকির কারণ রয়েছে—
নিয়মিত মদ্যপান
জর্দা, সাদাপাতা বা খয়ের খাওয়া
অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার
খুব গরম খাবার নিয়মিত খাওয়া
দীর্ঘ সময় ধরে কণ্ঠস্বরের অতিরিক্ত ব্যবহার (যেমন শিক্ষক, গায়ক, রাজনীতিবিদ)
বয়স বেশি হওয়া (বিশেষ করে ৫০ বছরের বেশি বয়সী)
পুরুষদের মধ্যে এ ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা বেশি
পরিবেশ দূষণ ও রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ
প্রাথমিক লক্ষণ ও উপসর্গ
কণ্ঠনালির ক্যানসার প্রথম দিকে ধরা পড়লে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। কিন্তু অনেকেই প্রাথমিক লক্ষণকে অবহেলা করেন। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো—
কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন বা ভাঙা স্বর, যা ১৫ দিনের বেশি স্থায়ী হয়
শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে অসুবিধা
গলায় কিছু আটকে থাকার অনুভূতি
ঢোক গিলতে কষ্ট হওয়া
গলা ফুলে যাওয়া
গলার ব্যথা ছড়িয়ে কানে যাওয়া
অকারণে ওজন কমে যাওয়া
গলার চারপাশে লসিকাগ্রন্থি ফুলে ওঠা
রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি
কণ্ঠনালির ক্যানসার সন্দেহ হলে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। বর্তমানে বেশ কিছু আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে এ রোগ সহজেই শনাক্ত করা যায়—
ফাইবার অপটিক ভিডিও ল্যারিঙ্গোস্কপি: এতে রোগী নিজেও টিভির পর্দায় কণ্ঠনালি দেখতে পারেন।
বায়োপসি পরীক্ষা: গলার ভেতর থেকে ছোট টিস্যু সংগ্রহ করে হিস্টোপ্যাথলজিতে পরীক্ষা করা হয়।
সিটি স্ক্যান/এমআরআই: ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে কি না তা নির্ণয়ে সহায়ক।
রক্ত পরীক্ষা: সার্বিক স্বাস্থ্য অবস্থা বোঝার জন্য।
চিকিৎসা
কণ্ঠনালির ক্যানসারের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগ কোন পর্যায়ে ধরা পড়েছে তার ওপর।
প্রাথমিক পর্যায়ে → রেডিওথেরাপির মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায়।
মধ্যবর্তী পর্যায়ে → কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি একসাথে প্রয়োগ করা হয়।
শেষ পর্যায়ে → অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায় থাকে না। অনেক সময় শ্বাস নিতে গলায় কৃত্রিম টিউব (ট্রাকিওস্টমি) বসাতে হয়।
অস্ত্রোপচারের পর সমস্যা
যদি স্বরযন্ত্র পুরোপুরি কেটে ফেলতে হয়, তাহলে রোগী স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হয়, যেমন—
কৃত্রিম স্বরযন্ত্র সংযোজন
খাদ্যনালির মাধ্যমে কথা বলার প্রশিক্ষণ
আধুনিক ভয়েস রিহ্যাবিলিটেশন টেকনিক
প্রতিরোধের উপায়
যে কোনো রোগের চেয়ে প্রতিরোধই সর্বোত্তম। কণ্ঠনালির ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয় হলো—
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সম্পূর্ণ পরিহার করা
অ্যালকোহল না খাওয়া
অতিরিক্ত ঝাল ও গরম খাবার এড়িয়ে চলা
কণ্ঠনালির অযথা ব্যবহার কমানো
দূষিত পরিবেশে কাজ করলে মাস্ক ব্যবহার করা
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
১৫ দিনের বেশি গলার স্বরে পরিবর্তন থাকলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া
উপসংহার
কণ্ঠনালির ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে জীবন রক্ষা করা সম্ভব এবং রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। তাই সচেতনতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস থেকে বিরত থাকাই এই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।