টনসিলে ফোড়া: কারণ, লক্ষণ ও করণীয়

টনসিলে ফোড়া: কারণ, লক্ষণ ও করণীয়

টনসিলে ফোড়া: কারণ, লক্ষণ ও করণীয়

গলা ব্যথা, খাবার গিলতে কষ্ট, মুখ হাঁ করতে সমস্যা—এসব উপসর্গ অনেকের কাছেই পরিচিত। সাধারণ টনসিলের প্রদাহ হিসেবে শুরু হলেও সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি জটিল আকার ধারণ করে টনসিলে ফোড়ায় রূপ নিতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে বলা হয় Peritonsillar Abscess (পেরিটনসিলার অ্যাবসেস)। এটি হলো টনসিলের আশপাশে ও নিচের অংশে পুঁজ জমে যাওয়া—যা মূলত এক ধরনের গভীর সংক্রমণ।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এটি একটি পরিচিত কিন্তু অবহেলিত সমস্যা। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া, ধুলাবালি, ঠান্ডাজনিত সংক্রমণ, এবং চিকিৎসায় অনিয়মের কারণে এ রোগের প্রকোপ এখানকার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

টনসিলের কাজ ও ফোড়া হওয়ার প্রক্রিয়া

টনসিল হচ্ছে গলার দুই পাশে অবস্থিত দুটি ছোট লিম্ফ টিস্যু, যা মূলত দেহের প্রতিরোধব্যবস্থার অংশ। এগুলো মুখ দিয়ে প্রবেশ করা ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসকে আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যখন বারবার ইনফেকশন হয়, তখন টনসিল নিজেই সংক্রমিত হয়ে যায়—একেই বলা হয় টনসিলাইটিস।

যদি টনসিলাইটিসের চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকে বা সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন টনসিলের পাশের জায়গায় (peritonsillar space) জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে পুঁজ জমে ফোড়া তৈরি হয়।
ফোড়াটি সাধারণত এক পাশেই হয় (বাম বা ডান), ফলে রোগী মুখ এক পাশে কাত করে কথা বলেন ও খাওয়ার সময় তীব্র ব্যথা অনুভব করেন।

 টনসিলে ফোড়ার কারণ

টনসিলে ফোড়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো স্ট্রেপটোকক্কাস পাইোজিনস (Streptococcus pyogenes) নামের ব্যাকটেরিয়া। তবে অন্যান্য জীবাণু যেমন স্ট্যাফাইলোকক্কাস, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, এবং অ্যানারোবিক ব্যাকটেরিয়াও দায়ী হতে পারে।

এ ছাড়া নিচের কারণগুলোও ঝুঁকি বাড়ায়—

দীর্ঘদিনের অপরিচিকিৎসিত টনসিলাইটিস

বারবার ঠান্ডা লাগা বা ভাইরাল সংক্রমণ

ধূমপান বা মদ্যপান

মুখ ও দাঁতের অপরিচ্ছন্নতা

দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা

অ্যালার্জি বা সাইনাস ইনফেকশন

প্রচণ্ড ঠান্ডা বা ধুলাবালিযুক্ত পরিবেশে কাজ করা

 কারা বেশি ঝুঁকিতে

যদিও টনসিলের প্রদাহ শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, টনসিলে ফোড়া তুলনামূলকভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই বেশি হয়।
বিশেষ করে—

যাদের বারবার টনসিলের ইনফেকশন হয়

যারা ধূমপান করেন

যাদের মুখের পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকে না

যারা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স অসম্পূর্ণ রাখেন

লক্ষণ ও উপসর্গ

টনসিলে ফোড়া শুরুতে সাধারণ টনসিলাইটিসের মতো মনে হলেও কয়েক দিনের মধ্যে এর উপসর্গ তীব্র হয়ে ওঠে। লক্ষণগুলো হলো—

তীব্র গলাব্যথা: এক পাশের গলায় বেশি হয় এবং ব্যথা কানে ছড়িয়ে পড়ে।

মুখ হাঁ করতে অসুবিধা: মুখ খোলার সময় পেশিতে টান পড়ে, যাকে “ট্রিসমাস” বলা হয়।

খাবার গিলতে কষ্ট: পুঁজ ও প্রদাহের কারণে খাবার বা পানি গিললেই ব্যথা হয়।

জ্বর: শরীরের তাপমাত্রা ১০৩–১০৪°F পর্যন্ত উঠতে পারে।

কণ্ঠস্বর পরিবর্তন: কণ্ঠ ভারী হয়ে যায় বা নাক বন্ধ কণ্ঠের মতো শোনায়।

লালা ঝরা: গিলতে না পারায় মুখ দিয়ে লালা বের হয়।

মুখ থেকে দুর্গন্ধ: পুঁজ ও জীবাণুর কারণে।

গলার এক পাশে ফোলাভাব: বাহির থেকে দেখলেও ফোলা ভাব বোঝা যায়।

সার্বিক দুর্বলতা, মাথাব্যথা ও ঘাড়ে ব্যথা।

চিকিৎসা বিলম্ব হলে ফোড়া ফেটে গিয়ে পুঁজ গলার ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা জীবনহানিকর হতে পারে।

 জটিলতা

চিকিৎসা না করালে টনসিলে ফোড়া নানা জটিলতায় রূপ নিতে পারে—

শ্বাসকষ্ট: ফোড়া বড় হলে শ্বাসনালি চেপে ধরে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

গলার সেলুলাইটিস: ইনফেকশন আশপাশের টিস্যুতে ছড়িয়ে ফুলে যেতে পারে।

সেপ্টিসেমিয়া: জীবাণু রক্তে ছড়িয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে সংক্রমণ ঘটায়।

নিউমোনিয়া বা লাং অ্যাবসেস: পুঁজ ফুসফুসে গেলে মারাত্মক সংক্রমণ হয়।

মধ্যকর্ণের ইনফেকশন (Otitis Media): কানে ব্যথা ও শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।

চিকিৎসা

টনসিলে ফোড়ার চিকিৎসা কখনোই গৃহস্থালি পদ্ধতিতে করা উচিত নয়। এটি সম্পূর্ণ চিকিৎসকনির্ভর সমস্যা। চিকিৎসার ধাপগুলো হলো—

অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি

চিকিৎসক সাধারণত ইনজেকশন বা ট্যাবলেট আকারে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক দেন। যেমন—

পেনিসিলিন

ক্লিন্ডামাইসিন

সেফট্রিয়াক্সন
এগুলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

ব্যথা ও জ্বর নিয়ন্ত্রণ

ব্যথা ও জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন দেওয়া হয়।

পুঁজ বের করা (Incision & Drainage)

ফোড়া বড় হলে স্থানীয় অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে ছোট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পুঁজ বের করে দেওয়া হয়। এতে রোগী দ্রুত আরাম পান ও ব্যথা কমে যায়।

তরল খাবার ও বিশ্রাম

রোগীকে কয়েকদিন তরল বা নরম খাবার খেতে বলা হয় এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

টনসিলেকটমি (Tonsillectomy)

যদি রোগী বারবার টনসিলের ফোড়ায় আক্রান্ত হন, তবে সম্পূর্ণ টনসিল অপসারণের (টনসিলেকটমি) পরামর্শ দেওয়া হয়। সাধারণত ফোড়া সেরে যাওয়ার ৪–৬ সপ্তাহ পর অপারেশন করা হয়।

 যত্ন ও ঘরোয়া করণীয়

চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু যত্ন রোগীকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে—

প্রতিদিন হালকা গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গার্গল করুন।

পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করুন।

মুখগহ্বর পরিষ্কার রাখুন, দিনে দুইবার দাঁত ব্রাশ করুন।

ধূমপান বা ঠান্ডা পানীয় এড়িয়ে চলুন।

অ্যান্টিবায়োটিকের পূর্ণ কোর্স শেষ করুন।

উচ্চ জ্বর বা ব্যথা বেড়ে গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 প্রতিরোধের উপায়

টনসিলে ফোড়া প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি নিচের অভ্যাসগুলো মেনে চলা যায়—

ঠান্ডা বা ধুলাবালিযুক্ত পরিবেশে মাস্ক ব্যবহার করা।

ঠান্ডা পানি, আইসক্রিম বা অতিরিক্ত ঠান্ডা খাবার পরিহার করা।

পর্যাপ্ত ঘুম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।

গলা ব্যথা বা টনসিলাইটিস হলে অবহেলা না করা।

নিয়মিত গার্গল করা ও মুখ পরিষ্কার রাখা।

ধূমপান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা।

 চিকিৎসকের পরামর্শ

ইএনটি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম আলমগীর চৌধুরী বলেন,

“টনসিলের ফোড়া একটি জটিল সংক্রমণ। অনেক রোগী দেরি করে আসেন, তখন পুঁজ শ্বাসনালি বা ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে। তাই গলাব্যথা ও জ্বরের সঙ্গে মুখ হাঁ করতে অসুবিধা হলে দেরি না করে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।”

তিনি আরও বলেন,

“অ্যান্টিবায়োটিক ও সঠিক চিকিৎসা শুরু করলে রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায়। তবে পুনরায় যেন না হয়, এজন্য টনসিলেকটমি করা অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়।”

 উপসংহার

টনসিলের ফোড়া কোনো সাধারণ অসুস্থতা নয়। এটি দ্রুত জটিল রূপ নিতে পারে এবং চিকিৎসা বিলম্ব হলে প্রাণঘাতীও হতে পারে।
তাই গলা ব্যথা বা মুখ হাঁ করতে কষ্ট হলে নিজে থেকে ওষুধ না খেয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ পথ।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা, নিয়মিত যত্ন, এবং পরিচ্ছন্ন অভ্যাস—এই তিনটি বিষয় মানলেই টনসিলের ফোড়া পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *