আগুনে পোড়া রোগীর চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি: মৃত্যু থেকে জীবনে ফেরার দীর্ঘ যাত্রা
একটি দুর্ঘটনার দীর্ঘ ছায়া
২১ জুলাই—বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবন কতটা অনিশ্চিত। উত্তরার একটি স্কুলে ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনা মুহূর্তেই কেড়ে নিয়েছিল প্রাণ, ধ্বংস করেছিল অসংখ্য পরিবারে স্বপ্ন। শিশুদের শরীর আগুনে দগ্ধ হয়েছিল, কারও ৩০ শতাংশ, কারও ৫০ শতাংশ। তীব্র যন্ত্রণায় তারা কাতরাচ্ছিল। কেউ মরফিন চাইছিল, কেউ নিঃশব্দে সহ্য করছিল।
এই দুর্ঘটনা শুধু একটি ঘটনার স্মৃতি নয়, বরং হাজারো বার্ন রোগীর প্রতিদিনকার বাস্তবতা। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি হাসপাতালে আগুনে পোড়া রোগীরা চিকিৎসার জন্য ছুটছেন। তাদের কাছে জীবন মানে আর শুধু বেঁচে থাকা নয়—বরং আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা। আর সেই ফেরার মূল চাবিকাঠি হলো ফিজিওথেরাপি।
বার্ন চিকিৎসার ধাপ ও ফিজিওথেরাপির ভূমিকা
বার্ন চিকিৎসা একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ—যেখানে চিকিৎসক, সার্জন, নার্স, ফিজিওথেরাপিস্ট, মনোবিদ, ডায়েটিশিয়ান—সবাই একসঙ্গে কাজ করেন।
ফিজিওথেরাপি এখানে শুধু একটি সাপোর্টিভ থেরাপি নয়, বরং লাইফ-সেভিং ও লাইফ-চেঞ্জিং ইন্টারভেনশন।
প্রাথমিক ধাপ (Acute Phase)
শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ: আগুন ও ধোঁয়া রোগীর ফুসফুসে জটিলতা তৈরি করে। Chest Physiotherapy ফুসফুস সচল রাখে।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক অবস্থান: শোওয়ার সময় ভঙ্গি ঠিক না হলে শরীর বেঁকে যেতে পারে। ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর ভঙ্গি ঠিক করে দেন।
ব্যথা নিয়ন্ত্রণ ও জয়েন্ট মুভমেন্ট: ক্ষতস্থানের আশেপাশে নড়াচড়া না করলে জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়। নরমাল ROM (Range of Motion) বজায় রাখতে হালকা মুভমেন্ট করা হয়।
সার্জারি-পরবর্তী ধাপ
গ্রাফটিং-এর পর থেরাপি: চামড়া প্রতিস্থাপনের পরে জটিলতা এড়াতে নির্দিষ্ট এক্সারসাইজ করা জরুরি।
ব্যান্ডেজ ও স্প্লিন্ট ব্যবহার শেখানো: রোগী যেন বিকলাঙ্গ না হয়ে যায়, সেজন্য নিয়মিত থেরাপি।
৩ দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন (Rehabilitation Phase)
জয়েন্ট ও মাংসপেশির শক্তি পুনরুদ্ধার
কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহারে প্রশিক্ষণ (যদি অঙ্গহানি ঘটে)
হাঁটা-চলা, লেখাপড়া, কর্মজীবনে ফেরা
মানসিক পুনর্বাসন: ফিজিওথেরাপি সেশন অনেক সময় রোগীর আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
রোগীদের জীবনের গল্প
তাসনিয়া: ছোট্ট মেয়েটি বার্ন ইনজুরির পরে প্রতিদিন দুঃস্বপ্ন দেখত। শেষ পর্যন্ত সে বেঁচে থাকতে পারেনি, কিন্তু তার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি রোগীর জন্য সময়মতো থেরাপি কতটা জরুরি।
আরিয়ান: আইসিইউ থেকে ফিরেও বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গেছে। নিয়মিত ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে সে আবার হাঁটা শিখছে। তার মা বলেন—“ফিজিওথেরাপি না থাকলে হয়তো আজ আমার ছেলে বিছানাতেই থাকত।”
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
যুক্তরাষ্ট্র: American Burn Association নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি বার্ন সেন্টারে ফিজিওথেরাপিস্ট বাধ্যতামূলক।
অস্ট্রেলিয়া: “Burns Physiotherapy Guidelines” অনুযায়ী প্রতিটি রোগীকে সার্জারির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ফিজিওথেরাপি শুরু করতে হয়।
ভারত: দিল্লি ও মুম্বাইয়ের বার্ন সেন্টারগুলোতে ফিজিওথেরাপি দীর্ঘমেয়াদি রিহ্যাব প্রোগ্রামের অন্যতম স্তম্ভ।
বাংলাদেশে যদিও জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও সিআরপি উল্লেখযোগ্য কাজ করছে, তবে সারাদেশব্যাপী স্পেশালাইজড বার্ন রিহ্যাব সেন্টার এখনও পর্যাপ্ত নয়।
বার্ন রোগীর পরিবার ও সমাজের চ্যালেঞ্জ
বার্ন রোগীরা প্রায়শই সমাজে স্টিগমা ও বৈষম্যের শিকার হন। পোড়া দাগ দেখে অনেকেই তাদের এড়িয়ে চলেন। অনেকেই চাকরি হারান, স্কুলে ফেরা কঠিন হয়, বিবাহে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়।
এখানে ফিজিওথেরাপি শুধু শারীরিক চিকিৎসা নয়—এটি রোগীকে আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে দেয়।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক
বার্ন রোগীর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
WHO অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে বার্ন চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় অনেক পরিবার বহন করতে পারে না।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হলেও তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী এবং ফলপ্রসূ।
রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকদের করণীয়
প্রতিটি জেলা হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে ফিজিওথেরাপি সার্ভিস বাধ্যতামূলক করা।
ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ।
বার্ন রোগীর জন্য রিহ্যাবিলিটেশন ফান্ড গঠন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে বার্ন ও ফিজিওথেরাপি নিয়ে সচেতনতা ক্যাম্পেইন।
স্কুল-কলেজে ফায়ার সেফটি ও ফার্স্ট এইড প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক।
উপসংহার
আগুন মুহূর্তেই শরীর ও স্বপ্ন পুড়িয়ে দেয়, কিন্তু সেখান থেকে রোগীকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারে ফিজিওথেরাপি। ক্ষত সারানোর চিকিৎসকরা জীবন দেন, আর ফিজিওথেরাপিস্টরা সেই জীবনকে চলাফেরা, আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনতা ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেন।
বাংলাদেশের প্রতিটি অগ্নিদগ্ধ রোগী যেন এই সেবা পায়, সেটি শুধু চিকিৎসার চাহিদা নয়—এটি একটি মানবিক অধিকার।