বিশ্ব ফুসফুস দিবস: সুস্থ ফুসফুসে সুস্থ জীবন
আজ ২৫ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব ফুসফুস দিবস। প্রতি বছর এ দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় মানুষের ফুসফুসের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য হলো— “সুস্থ ফুসফুস, সুস্থ জীবন”। ফুসফুস আমাদের শরীরের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, যার কার্যকারিতা ব্যাহত হলে পুরো দেহই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সুস্থ জীবনের অন্যতম শর্ত হলো সুস্থ ফুসফুস।
কেন ফুসফুসের যত্ন জরুরি
ফুসফুস শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে দেয়। এই প্রক্রিয়াটি যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে সহজ কাজগুলোও কঠিন হয়ে পড়ে—যেমন হাঁটা, সিঁড়ি ভাঙা বা ব্যায়াম করা। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ছে এবং এ রোগগুলো প্রতিবছর লাখো মানুষের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।
করোনা মহামারির পর থেকে ফুসফুসের স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। ভাইরাসজনিত সংক্রমণ যেমন নিউমোনিয়া বা কোভিড-১৯ ফুসফুসকে সরাসরি আক্রমণ করে। আবার ধূমপান, বায়ুদূষণ, অ্যালার্জি এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুসকে দুর্বল করে দেয়।
ফুসফুসের সাধারণ রোগ
অ্যাজমা: বিশ্বে প্রায় ২৬ কোটি মানুষ এ রোগে ভুগছেন। হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এর প্রধান লক্ষণ।
সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ): প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। ধূমপান ও দূষণ প্রধান কারণ।
ফুসফুসের ক্যানসার: প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যুহারও অত্যন্ত বেশি।
যক্ষ্মা: গত এক দশকে এর প্রকোপ আবার বেড়েছে। উন্নয়নশীল দেশে এখনো এটি বড় চ্যালেঞ্জ।
নিউমোনিয়া ও অন্যান্য সংক্রমণ: প্রতিবছর প্রায় ২৪ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ। বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি ঝুঁকিতে।
ফুসফুস সুস্থ রাখার উপায়
শ্বাসের ব্যায়াম করুন
প্রতিদিন ১০–১৫ মিনিট গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ায়। বিশেষ করে অ্যাজমা বা সিওপিডি রোগীদের জন্য এটি কার্যকর।
নিয়মিত শরীরচর্চা
হালকা জগিং, দ্রুত হাঁটা, সাইক্লিং কিংবা যোগব্যায়াম ফুসফুসের কার্যকারিতা উন্নত করে। তবে খুব ভারী ব্যায়াম না করাই ভালো।
সুষম খাদ্যাভ্যাস
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শাকসবজি, ফল, বাদাম, মাছ ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার ফুসফুসের জন্য উপকারী। যেসব খাবারে অ্যালার্জি হয় সেগুলো এড়াতে হবে।
পরিষ্কার পরিবেশে থাকুন
গাড়ির ধোঁয়া, কারখানার দূষণ ও ধুলাবালি থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকুন। ঘর পরিষ্কার ও ধুলামুক্ত রাখতে হবে।
মানসিক চাপ কমান
স্ট্রেস ফুসফুসের কার্যকারিতা প্রভাবিত করে। তাই বিশ্রাম, মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
টিকাদান গ্রহণ করুন
শিশুদের নিয়মিত টিকা দিন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া ও করোনাভাইরাসের টিকা অত্যন্ত জরুরি।
মেনে চলতে হবে যেসব অভ্যাস
ধূমপান একেবারেই বাদ দিন। ধূমপায়ী শুধু নিজেই নয়, তাঁর আশপাশের মানুষকেও ঝুঁকিতে ফেলেন।
বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করুন, বিশেষত ধুলাবালি বা দূষিত পরিবেশে।
ঘরে কার্পেট, লোমশ খেলনা ও ভারী পর্দা ব্যবহার করবেন না। এগুলোতে ধুলো জমে অ্যালার্জি বাড়ায়।
বিছানার কম্বল বা বালিশে সুতি কাপড়ের কভার ব্যবহার করুন।
মৌসুমি ফুলের রেণু ছড়ালে দরজা-জানালা বন্ধ রাখুন।
তীব্র গন্ধযুক্ত সুগন্ধি বা রাসায়নিক স্প্রে এড়িয়ে চলুন।
কাঠ, কয়লা, গোবর বা প্লাস্টিক পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করবেন না।
বাড়ির ভেতরে ও আশেপাশে গাছ লাগান, যা বাতাস বিশুদ্ধ রাখবে।
বৈশ্বিক বৈষম্য ও সচেতনতার প্রয়োজন
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীর সব অঞ্চলে ফুসফুসের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সমান সুযোগ নেই। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধ সহজলভ্য, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পান না। এর ফলে মৃত্যুহারও বাড়ছে।
তাই শুধু ব্যক্তিগত সচেতনতা নয়, বরং নীতি-নির্ধারক, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। টেকসই পরিবেশ, পরিষ্কার বাতাস, সহজলভ্য চিকিৎসা এবং জনসচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে এ রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব।
উপসংহার
ফুসফুস আমাদের জীবনের প্রাণ। এর সুস্থতা ছাড়া দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন কল্পনা করা যায় না। প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাস—যেমন ধূমপান ত্যাগ, ব্যায়াম, সুষম খাদ্য, টিকা গ্রহণ ও পরিবেশ রক্ষা—ফুসফুসকে দীর্ঘদিন কার্যকর রাখতে পারে।
তাই আসুন, বিশ্ব ফুসফুস দিবসে প্রতিজ্ঞা করি—নিজের ও অন্যের ফুসফুস সুস্থ রাখতে আমরা সবাই সচেতন হবো। সুস্থ ফুসফুস মানেই সুস্থ জীবন।