বাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সহজ উপায়

বাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সহজ উপায়

গেঁটে বাত (গাউট): একটি বিস্তৃত গাইড

গেঁটে বাত বা গাউট হলো এক ধরনের প্রদাহজনিত আর্থ্রাইটিস, যা শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের অতিরিক্ত জমার কারণে গাঁটে স্ফটিকের সৃষ্টি হলে দেখা দেয়। এটি প্রাথমিকভাবে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে দেখা দেয়, তবে শরীরের যে কোনো জয়েন্টে আক্রান্ত হতে পারে। হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা, লালচে ভাব, ফোলাভাব এবং গরম ভাব সাধারণ লক্ষণ। কখনও কখনও রোগী রাতে বা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর গাঁটে জ্বালা অনুভব করতে পারেন।

 গেঁটে বাতের কারণ

গেঁটে বাত মূলত রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের অতিরিক্ত জমার কারণে হয়। ইউরিক অ্যাসিড হলো পিউরিন নামক প্রাকৃতিক যৌগের বিপাকজাত বর্জ্য, যা সাধারণত কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তবে নিম্নোক্ত কারণে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পেতে পারে:

কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে ইউরিক অ্যাসিড ঠিকমতো বের হয় না।

পিউরিন সমৃদ্ধ খাদ্য বেশি খাওয়া (লাল মাংস, কিছু মাছ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ)।

অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা।

এলকোহল, বিশেষ করে বিয়ার ও মদ্যপান।

পারিবারিক ইতিহাস— পরিবারের কারো গাউট থাকলে ঝুঁকি বেশি।

নির্দিষ্ট ধরনের ওষুধ, যেমন কিছু ডায়ুরেটিক ও কেমোথেরাপি ওষুধ।

গেঁটে বাত কেবল ব্যথা সৃষ্টি করে না, বরং দীর্ঘমেয়াদি হলে কিডনি বা হার্ট সংক্রান্ত জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়।

লক্ষণ

গেঁটে বাতের প্রধান লক্ষণগুলো হলো:

হঠাৎ জোড়ায় তীব্র ব্যথা

লালচে বা ফোলা জয়েন্ট

গরম ভাব ও স্পর্শকাতরতা

হঠাৎ আক্রমণ সাধারণত রাতে বা সকালে বেশি

প্রাথমিকভাবে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রভাবিত হয়, তবে হাঁটু, গোড়ালি, কবজি, আঙুলের জয়েন্টেও দেখা দিতে পারে

ধীরে ধীরে ক্রনিক গাউট হলে, জয়েন্টে স্থায়ী ক্ষতি ও ডিফর্মিটি দেখা দিতে পারে।

খাদ্যাভ্যাস: কী খাবেন এবং কী খাবেন না

কী খাবেন:

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল: আমলকি, লেবু, কমলা, পেয়ারা, কিউই, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, পেঁপে। ভিটামিন সি ইউরিক অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়াতে ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

আনারস ও আপেল: আনারসে থাকা ব্রোমেলিন ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে কার্যকর। আপেল ও অ্যাপেল সিডার ভিনেগার লিভার ডিটক্সে সহায়ক।

লো-ফ্যাট প্রোটিন: ডিমের সাদা অংশ, লো-ফ্যাট দুধ, টক দই, ছানা, কাঠবাদাম, দেশি নদীর মাছ যেমন রুই, কাতল, পাবদা। এগুলো তুলনামূলকভাবে কম পিউরিনযুক্ত।

আঁশযুক্ত খাবার: লাউ, পেঁপে, গাজর, করলা, কুমড়া, শাকসবজি। দৈনিক অন্তত ৪০০ গ্রাম আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে ইউরিক অ্যাসিড শোষণ কমে।

পর্যাপ্ত পানি: দিনে অন্তত ১২ গ্লাস পানি পান কিডনির কার্যকারিতা বাড়ায়। গ্রিন-টি, লেবু পানি, আদা পানি ও ডাবের পানি সহায়ক।

স্বাস্থ্যকর চর্বি ও মসলা: ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ তেল (ওলিভ, সরিষার তেল), আদা, রসুন, হলুদ, গোলমরিচ প্রদাহ ও ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।

কী খাবেন না:

লাল মাংস (গরু, খাসি), প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (কলিজা, পায়া), ইলিশ, চিংড়ি, শুঁটকি, ছোলা, রাজমা, সয়া প্রোডাক্ট।

ইস্ট ও ফ্রুকটোজযুক্ত খাবার— পাউরুটি, কেক, কোমল পানীয়, চকলেট, চিনি-গুড়-মিষ্টি, মধু।

উচ্চ পিউরিনযুক্ত সবজি— পুই, পালং শাক, মটরশুঁটি, মাশরুম।

প্রসেসড ফুড, ট্রান্স ফ্যাট, ইনস্ট্যান্ট রেডি-টি ইট মিল।

মদ্যপান, বিয়ার, ধূমপান।

সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করুন: কলা, আম, কাঁঠাল, সাদা চালের ভাত, নুডলস, পাস্তা ইত্যাদি উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার।

 জীবনযাপনে পরিবর্তন

রোদে থাকা: প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট রোদে থাকুন— ভিটামিন ডি ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

ঘুমের গুরুত্ব: রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত গভীর ঘুম নিশ্চিত করুন।

নিয়মিত ব্যায়াম: হালকা ব্যায়াম, যোগব্যায়াম ও হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

মানসিক চাপ কমানো: স্ট্রেস হরমোন ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পারে। মেডিটেশন ও বিশ্রাম সহায়ক।

চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবস্থাপনা

গেঁটে বাতের চিকিৎসা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে। সাধারণত ব্যবহৃত ওষুধগুলো:

নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs): ব্যথা ও ফোলাভাব কমাতে ব্যবহৃত।

কোলচিসিন: গাউট আক্রমণ কমাতে সহায়ক।

কোর্টিকোস্টেরয়েড: জটিল ক্ষেত্রে প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে।

ইউরিক এসিড-লাওয়ারিং মেডিসিন: অ্যালোপুরিনল, ফেবুকসোস্ট্যাট ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনায়।

ওষুধের পাশাপাশি খাদ্য ও জীবনযাপন পরিবর্তন অপরিহার্য।

 প্রতিরোধমূলক পরামর্শ

যথেষ্ট পানি পান করুন।

পিউরিন সমৃদ্ধ খাদ্য সীমিত করুন।

নিয়মিত ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণ।

এলকোহল ও ধূমপান এড়িয়ে চলুন।

স্ট্রেস ও ঘুম নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করুন, বিশেষ করে কিডনি ও লিভারের ফাংশন।

উপসংহার

গেঁটে বাত কেবল একটি আর্থ্রাইটিসের সমস্যা নয়, এটি জীবনযাপনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একটি রোগ। এটি নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি হলো সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত চিকিৎসা অনুসরণ। রোগীকে অবশ্যই পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য তালিকা গ্রহণ করতে হবে এবং নিজস্বভাবে ওষুধ বা খাদ্য পরিবর্তন করা উচিত নয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করেন, নিয়মিত ব্যায়াম করেন এবং স্ট্রেস ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তাদের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং গাঁটে প্রদাহ ও ব্যথার ঝুঁকি অনেক কমে।

লেখক: পুষ্টিবিদ, বায়োজিন কসমোসিউটিকেলস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *