তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও করণীয়
প্রচণ্ড গরমে সবচেয়ে ভয়াবহ তাপজনিত অসুস্থতার নাম হিট স্ট্রোক। এটি শুধু সাময়িক অস্বস্তিই নয়, বরং জীবনঘাতী জটিলতা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে আমাদের দেশে তীব্র গরম, আর্দ্রতা এবং দীর্ঘ সময় রোদের নিচে কাজ করার কারণে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। সচেতনতার অভাব, পানিশূন্যতা এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা না নেওয়ার কারণে প্রতিবছর বহু মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন।
হিট স্ট্রোক কেন হয়?
মানবদেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঘামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে শরীর যখন আর ঘাম ঝরাতে সক্ষম হয় না, তখন শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়।
স্বাভাবিকভাবে শরীরের তাপমাত্রা ৩৭° সেলসিয়াস।
কিন্তু হিট স্ট্রোকে এটি ৪০° সেলসিয়াস বা তার বেশি হয়ে যায়।
এ অবস্থায় শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অচেতন অবস্থায় চলে যেতে পারে।
হিট স্ট্রোকের ধাপ
বিশেষজ্ঞরা হিট স্ট্রোক হওয়ার আগে শরীরকে সতর্ক সংকেত হিসেবে তিনটি ধাপে ভাগ করেছেন—
হিট ক্র্যাম্পস (Heat Cramps)
অতিরিক্ত ঘাম ও ডিহাইড্রেশনের কারণে মাংসপেশিতে ব্যথা ও খিঁচুনি হয়।
সাধারণত পা, হাত, পেট বা পিঠে এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়।
হিট এক্সহসশন (Heat Exhaustion)
অতিরিক্ত ক্লান্তি ও পানিশূন্যতা দেখা দেয়।
মাথা ঘোরা, প্রচণ্ড ঘাম হওয়া, দুর্বলতা, পেশি ব্যথা, দ্রুত শ্বাস নেওয়া, তৃষ্ণা—এগুলো প্রধান লক্ষণ।
হিট স্ট্রোক (Heat Stroke)
সবচেয়ে গুরুতর ধাপ।
শরীরের তাপমাত্রা ৪০° সেলসিয়াসের বেশি হয়ে যায়।
ঘাম বন্ধ হয়ে শরীর শুষ্ক হয়ে যায়।
মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, বিভ্রান্তি, অস্বাভাবিক আচরণ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং খিঁচুনি হতে পারে।
দ্রুত চিকিৎসা না করলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
হিট স্ট্রোকে কারা বেশি ঝুঁকিতে?
বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তি
শিশু (তাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম)
প্রতিবন্ধী ও শয্যাশায়ী রোগী
শ্রমিক, দিনমজুর, কৃষক, রিকশাচালক প্রমুখ যারা রোদে দীর্ঘ সময় কাজ করেন
খেলোয়াড় বা যারা প্রচণ্ড গরমে শারীরিক পরিশ্রম করেন
হিট স্ট্রোকের লক্ষণ
মাথা ব্যথা ও মাথা ঘোরা
চোখে ঝাপসা দেখা
দুর্বলতা ও অস্থিরতা
পেশিতে টান বা ব্যথা
বমি বমি ভাব বা বমি
অস্বাভাবিক আচরণ বা বিভ্রান্তি
খিঁচুনি
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
আক্রান্ত হলে প্রাথমিক করণীয়
আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবিলম্বে ছায়াযুক্ত বা ঠান্ডা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
টাইট কাপড় থাকলে খুলে ঢিলেঢালা কাপড় পরাতে হবে।
ফ্যান বা এসি চালু করতে হবে (যদি সম্ভব হয়)।
ঠান্ডা পানি দিয়ে শরীর মুছতে হবে বা মুখে পানির ঝাপটা দিতে হবে।
দ্রুত হাসপাতাল বা নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
মনে রাখবেন, সময়মতো চিকিৎসা না হলে হিট স্ট্রোক প্রাণঘাতী হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে জীবনযাত্রায় কয়েকটি সহজ পরিবর্তনই যথেষ্ট—
প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া। বিশেষ করে দুপুরের প্রচণ্ড রোদে।
বাইরে গেলে ছাতা, টুপি বা গামছা ব্যবহার করুন।
ঢিলেঢালা, সুতির পোশাক পরুন।
প্রচুর পানি পান করুন। দিনে অন্তত ২–৩ লিটার।
ওরস্যালাইন ও ফলের রস পান করুন। এতে শরীরের লবণ ও খনিজ পূরণ হয়।
অ্যালকোহল, ক্যাফেইন ও অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন।
খাবারের প্রতি সতর্ক থাকুন। খোলা খাবার বা নোংরা পরিবেশে তৈরি শরবত-চা একেবারেই খাবেন না।
ডায়রিয়া প্রতিরোধ করুন। বাসি বা দূষিত খাবার এড়িয়ে চলুন।
একনাগারে কাজ করবেন না। শ্রমিক ও দিনমজুরদের অন্তত আধা ঘণ্টা পরপর ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হবে।
হিট স্ট্রোক ছাড়াও গরমে যে রোগগুলো বাড়ে
ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগ যেমন টাইফয়েড, জন্ডিস
নিউমোনিয়া, কাশি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা
ত্বকের রোগ ও ফুসকুড়ি
জ্বর ও হিট এক্সহসশন
উপসংহার
হিট স্ট্রোক হলো একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি আমরা আগে থেকে সচেতন হই। নিয়মিত পানি পান, সঠিক পোশাক ব্যবহার, রোদে সতর্কতা এবং আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক সেবা—এসবই পারে জীবন বাঁচাতে। মনে রাখতে হবে, প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা।
লেখক: আয়েশা আক্তার
উপ পরিচালক, ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতাল