স্কুলে দুর্ঘটনার শিক্ষা: সচেতনতা ও প্রস্তুতির জরুরি বার্তা
২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরার একটি স্কুলের ওপর একটি প্রশিক্ষণরত যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডির জন্ম দেয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় প্রাণ হারায় অনেকেই, যাদের বেশির ভাগই শিশু। আহতদের কেউ এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে হাসপাতালে। সারা দেশে এই দুর্ঘটনা গভীর শোকের ছায়া ফেলেছে, তবে এর মধ্যেই আমাদের ভাবতে হবে—কী শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে আমাদের সামনে।
প্রত্যেক দুর্ঘটনা একেকটা সতর্কবার্তা। এই দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—স্কুলগুলোতে প্রস্তুতিমূলক মহড়া ও দুর্যোগ মোকাবিলার প্রশিক্ষণ কতটা জরুরি।
দুর্যোগের সময় কী করব—এই অনুশীলন দরকার
পাঠ্যবইয়ে দুর্যোগ নিয়ে অনেক কিছু লেখা থাকলেও, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য হয় না, যদি না হাতে-কলমে মহড়া দেওয়া হয়। ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড বা অন্যান্য বিপদে শিক্ষার্থীরা কীভাবে দ্রুত ও নিরাপদে বেরিয়ে আসবে, কোথায় যাবে, কাকে ফোন করবে—এসব জ্ঞান স্কুলেই বারবার চর্চা করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও হাসপাতালের সঙ্গে স্কুলের যোগাযোগ থাকা উচিত, যেন জরুরি মুহূর্তে সময় নষ্ট না হয়।
স্কুলে নিরাপত্তা মানেই শুধু গেট নয়
প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, বিকল্প নির্গমনের পথ, ফার্স্টএইড বক্স—এসব শুধু বিলাসিতা নয়, জীবন বাঁচানোর সরঞ্জাম। স্কুলের অবকাঠামো তৈরি বা অনুমোদনের সময় এসব বিষয় প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল। অনেক স্কুল সরু গলিতে হওয়ায় জরুরি যানবাহন প্রবেশ করতেই পারে না, যা ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক।
প্রাথমিক চিকিৎসা ও মানসিক যত্ন
শুধু দুর্ঘটনায় নয়, দৈনন্দিন অসুস্থতা—যেমন শ্বাসকষ্ট, মৃগীরোগ, পানিতে ডোবা, সাপে কাটা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। স্কুলে প্রশিক্ষিত শিক্ষক বা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা সহায়তাকারী থাকা জরুরি।
এ ছাড়া দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র শিশুদের মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। তাই স্কুলগুলোয় মনোবিদ এনে নিয়মিত কাউন্সেলিং চালু করা উচিত, যেন তারা মানসিক ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারে।
শুধু শহরে নয়, অঞ্চলভেদে প্রস্তুতি ভিন্ন হওয়া উচিত
উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের প্রস্তুতি, পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড়ধস, বজ্রপ্রবণ এলাকায় বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায়—এসব স্থানীয় বাস্তবতা অনুযায়ী শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের এসব অঞ্চলে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে শুধু নিজেরাই নয়, তারাও একসময় অন্যদের রক্ষা করতে পারবে।
দুর্যোগে গাছ লাগানো ও পরিবেশ চেতনা
ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোয় শিক্ষার্থীদের গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করা যায়। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে গাছ লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষণ শিক্ষার একটা অংশ হওয়া উচিত। কারণ পরিবেশ সুরক্ষা ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব নয়।
শেষ কথা: নিয়মিত মহড়াই সবচেয়ে কার্যকর প্রস্তুতি
প্রতিটি স্কুলে প্রতি দুই মাস অন্তর বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ–দুর্ঘটনা বিষয়ক প্রস্তুতিমূলক মহড়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। এতে শুধু প্রাণহানি নয়, আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা এবং মানসিক ক্ষতির পরিমাণও অনেক কমে আসবে।
বিপদ কখন, কোথা থেকে আসবে—তা বলা যায় না। কিন্তু প্রস্তুতি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব। স্কুলশিক্ষা শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল নয়, জীবন রক্ষা করাও এক ধরনের শিক্ষা—এটা আমাদের এখনই বুঝতে হবে।
– তারিক মনজুর, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়