ভিটিলিগো বা শ্বেতীরোগ: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা
শ্বেতীরোগ কী?
ভিটিলিগো বা শ্বেতীরোগ একটি ত্বকের জটিল অবস্থা, যেখানে ত্বকে সাদা দাগ বা প্যাচ দেখা যায়। এটি কোনো সংক্রামক রোগ নয়, অর্থাৎ ছোঁয়াচে নয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে এই রোগকে ঘিরে নানা ধরনের কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত রয়েছে। বিশ্বজুড়ে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১%–২% মানুষের মধ্যে এ রোগ দেখা যায়।
শ্বেতীরোগের ধরন
শ্বেতীরোগ সাধারণত দুই ধরনের হয়—
সেগমেন্টাল ভিটিলিগো
শরীরের নির্দিষ্ট অংশে দ্রুত ছড়ায়।
সাধারণত তরুণ বয়সে হয়।
প্রায় ১০% ক্ষেত্রে এ ধরন দেখা যায়।
নন-সেগমেন্টাল ভিটিলিগো
শরীরের উভয় দিকে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
মোট ভিটিলিগো রোগীর ৯০% ক্ষেত্রে এ ধরনের হয়।
প্রধানত সূর্যের আলোয় থাকা অংশ যেমন মুখ, ঘাড়, ঠোঁট, হাত-পায়ে দেখা যায়।
নন-সেগমেন্টাল ভিটিলিগো আবার কয়েকটি ভাগে বিভক্ত:
সাধারণ (Generalized): দাগগুলো নির্দিষ্ট আকারের নয়, শরীরের যেকোনো জায়গায় হতে পারে।
অ্যাক্রোফেসিয়াল (Acrofacial): হাত-পায়ের আঙুল ও মুখে সাদা দাগ হয়।
মিউকোসাল (Mucosal): ঠোঁট বা মিউকাস মেমব্রেনে দেখা যায়।
ইউনিভার্সাল (Universal): শরীরের প্রায় সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
ফোকাল (Focal): এক জায়গায় শুরু হয়ে পরে সীমিতভাবে ছড়িয়ে পড়ে। শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
কেন হয় ভিটিলিগো?
শ্বেতীরোগের প্রধান কারণ হলো মেলানিন উৎপাদনকারী কোষ (মেলানোসাইট) ধ্বংস বা কাজ বন্ধ করে দেওয়া। এতে ত্বক তার স্বাভাবিক রঙ হারিয়ে ফেলে।
বংশগত কারণ: পরিবারে কারও শ্বেতীরোগ থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অটোইমিউন রোগ: শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজেই মেলানোসাইটকে আক্রমণ করে।
সানবার্ন: অতিরিক্ত সূর্যের তাপে অবস্থার অবনতি হয়।
রাসায়নিক পদার্থ: কিছু শিল্প রাসায়নিক ত্বকের রঞ্জক পদার্থ নষ্ট করে।
ত্বকের রঙ: সাধারণত গায়ের রং গাঢ় মানুষের মধ্যে বেশি হয়।
কীভাবে বুঝবেন?
ত্বকে দাগ বা প্যাচ সাদা বা হালকা ধূসর হয়ে যায়।
আক্রান্ত স্থানের চুল ধূসর বা সাদা হতে থাকে।
সাধারণত মুখ, ঠোঁট, হাত, বাহু, ঘাড় ও পায়ে দেখা যায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্যাচগুলো বড় হতে পারে।
চিকিৎসা কি সম্ভব?
ভিটিলিগোর স্থায়ী নিরাময় নেই। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে রোগের বিস্তার রোধ করা যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ত্বকের রং আংশিক ফিরে আসে।
প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি:
স্টেরয়েড ক্রিম: প্রাথমিক পর্যায়ে কার্যকর।
ইউভি থেরাপি (ফোটোথেরাপি): বিশেষ ধরনের আলো দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
এক্সাইমার লেজার: ছোট ও নির্দিষ্ট জায়গার দাগ দূর করতে ব্যবহৃত হয়।
সেলুলার গ্রাফটিং: ত্বকে নতুন কোষ প্রতিস্থাপন করা হয়।
ডিপিগমেন্টেশন: শরীরের বাকি অংশকেও হালকা করে সাদা দাগের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয় (গুরুতর ক্ষেত্রে)।
কসমেটিক কভার বা ট্যাটু: ছোট দাগ ঢাকতে মেকআপ বা মেডিকেল ট্যাটু ব্যবহার করা হয়।
যত্ন ও পরামর্শ
রোদে বের হলে অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
রাসায়নিক মিশ্রিত প্রসাধনী এড়িয়ে চলুন।
স্বাস্থ্যকর খাবার, যেমন ভিটামিন–বি১২, ফল ও সবজি খাওয়া ত্বকের জন্য উপকারী।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন, কারণ স্ট্রেস রোগ বাড়াতে পারে।
নিয়মিত চর্ম বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
উপসংহার
ভিটিলিগো জীবনঘাতী রোগ নয়, তবে এটি মানসিক চাপ ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে রোগীর আত্মবিশ্বাসে বড় প্রভাব ফেলে। সচেতনতা, সঠিক সময়ে চিকিৎসা এবং সামাজিক সহমর্মিতা রোগীর জীবনকে অনেক সহজ করে তুলতে পারে।