পেটব্যথা সবসময় গ্যাস্ট্রিক নয়: ফ্যাটি লিভারের ইঙ্গিত চিনবেন কীভাবে?

পেটব্যথা সবসময় গ্যাস্ট্রিক নয়: ফ্যাটি লিভারের ইঙ্গিত চিনবেন কীভাবে

ফ্যাটি লিভারের ব্যথা ও অন্যান্য কারণে পেটব্যথা: পার্থক্য বোঝা কেন এত জরুরি

পেটব্যথা একটি অত্যন্ত সাধারণ স্বাস্থ্যসমস্যা। শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক, এমনকি বয়স্কদেরও জীবনের কোনো না কোনো সময়ে পেটব্যথায় ভুগতে হয়। কখনো অতিরিক্ত খাওয়া, কখনো তৈলাক্ত বা মসলাদার খাবার খাওয়া, আবার কখনো মানসিক চাপের কারণে হজমে সমস্যা হলে পেটব্যথা দেখা দেয়। অনেক সময় এটি তুচ্ছ সমস্যা মনে হলেও, সব পেটব্যথাই যে হজমজনিত কারণে হয় না, সেটি মনে রাখা জরুরি। শরীরের অন্য অঙ্গ থেকেও ব্যথা প্রতিফলিত হয়ে পেটে অনুভূত হতে পারে।

এর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো লিভারের অসুখ—বিশেষ করে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ। সমস্যা হলো, ফ্যাটি লিভারের ব্যথাকে প্রায়শই সাধারণ গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির ব্যথা মনে করে অবহেলা করা হয়। কিন্তু পার্থক্য বুঝতে না পারলে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়, ফলে জটিলতা বাড়ার ঝুঁকি থাকে।

কেন পার্থক্য বোঝা জরুরি?

পেটব্যথা সাধারণত পাকস্থলী বা অন্ত্রের সমস্যার কারণে হয়, অন্যদিকে ফ্যাটি লিভারের ব্যথা আসে লিভার থেকে। অঙ্গ ভিন্ন, তাই ব্যথার ধরন, অবস্থান, সময়কাল এবং চিকিৎসাও ভিন্ন। যদি ফ্যাটি লিভারের ব্যথাকে গ্যাস্ট্রিক বা বদহজম মনে করা হয়, তবে রোগ ধরা পড়তে দেরি হয়। অনেক সময় রোগটি গুরুতর আকার ধারণ করলে তবেই রোগী চিকিৎসকের কাছে যান। তখন লিভারে স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায়। তাই পেটব্যথাকে কখনো অবহেলা করা উচিত নয়।

ফ্যাটি লিভার ডিজিজ কী?

ফ্যাটি লিভার ডিজিজ হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে লিভারে অস্বাভাবিকভাবে চর্বি জমতে থাকে।

এর দুই ধরন রয়েছে:

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD বা MASLD) – এটি মূলত স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাবের কারণে হয়।

অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ – অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে লিভারে চর্বি জমে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ফ্যাটি লিভারের রোগী দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এ রোগের প্রবণতা অনেক বেশি, কারণ এখানে অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও ডায়াবেটিসের হার ক্রমেই বাড়ছে।

সাধারণ পেটব্যথার কারণ

সব পেটব্যথা ফ্যাটি লিভারের কারণে নয়। এর আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন:

গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটি

পাকস্থলীর আলসার

অন্ত্রের সংক্রমণ

হজমের গোলমাল

অতিরিক্ত মসলাদার বা তৈলাক্ত খাবার খাওয়া

স্ট্রেস বা উদ্বেগ

খাদ্যনালির সমস্যা (GERD)

এসব কারণে হওয়া পেটব্যথা সাধারণত অস্থায়ী এবং ওষুধ বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ফ্যাটি লিভারের ব্যথা বনাম সাধারণ পেটব্যথার অবস্থানগত পার্থক্য

ফ্যাটি লিভারের ব্যথা: সাধারণত ডান দিকের ওপরের পেটে (পাঁজরের নিচে) হয়। অনেক সময় ব্যথা পিঠ বা ডান কাঁধেও ছড়িয়ে যায়।

সাধারণ পেটব্যথা: সাধারণত মাঝপেট বা ওপরের বাম দিকে হয়। খাওয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

ব্যথার ধরন

ফ্যাটি লিভারের ব্যথা: ব্যথা ভোঁতা, চাপধরা বা ভারী ধরনের। চর্বিযুক্ত খাবার খেলে বা অ্যালকোহল গ্রহণের পর ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। এটি দীর্ঘস্থায়ী ও বারবার ফিরে আসে।

সাধারণ পেটব্যথা: অনেক সময় তীক্ষ্ণ, জ্বালাপোড়া বা খিঁচুনির মতো। খাওয়ার ধরন বা মানসিক চাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। অ্যান্টাসিড নিলে দ্রুত কমে যায়।

ব্যথার সময়কাল

ফ্যাটি লিভার: দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে বা মাঝে মাঝে ফিরে আসে। খাবারের সঙ্গে সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।

সাধারণ পেটব্যথা: সাধারণত হঠাৎ শুরু হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই কমে যায়।

ফ্যাটি লিভার ও অন্যান্য কারণে পেটব্যথার সঙ্গে যুক্ত উপসর্গ

ফ্যাটি লিভার: ক্লান্তি, দুর্বলতা, বমি ভাব, ক্ষুধা না লাগা, গ্যাস, পেট ফাঁপা। জটিল অবস্থায় জন্ডিস, প্রস্রাব গাঢ় হওয়া, পেটে পানি জমা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

সাধারণ পেটব্যথা: বুকজ্বালা, ঢেকুর, অল্প খেলেই পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি, বমি ভাব, হজমে অসুবিধা।

জটিলতা

ফ্যাটি লিভার অবহেলা করলে এটি সিরোসিস, লিভার ক্যানসার বা লিভার ফেইলিউরের মতো গুরুতর রোগে রূপ নিতে পারে। অন্যদিকে সাধারণ পেটব্যথার কারণ যেমন গ্যাস্ট্রিক বা আলসার সময়মতো চিকিৎসা না করলে রক্তক্ষরণ, অন্ত্র ফেটে যাওয়া বা দীর্ঘমেয়াদী হজমজনিত সমস্যা তৈরি করতে পারে।

কবে চিকিৎসকের কাছে যাবেন

পেটব্যথা বারবার হলে

ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে

ব্যথার সঙ্গে জন্ডিস, প্রচণ্ড ক্লান্তি বা ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিলে

ওষুধ খেয়েও ব্যথা না কমলে

পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ শনাক্তকরণ

চিকিৎসকেরা ফ্যাটি লিভার শনাক্ত করতে যেসব পরীক্ষা করে থাকেন:

আল্ট্রাসনোগ্রাফি

লিভার ফাংশন টেস্ট

সিটি স্ক্যান বা এমআরআই

লিভার বায়োপসি (প্রয়োজনে)

অন্যদিকে সাধারণ পেটব্যথার ক্ষেত্রে গ্যাস্ট্রোস্কপি, এন্ডোস্কপি বা অন্যান্য রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে কারণ জানা যায়।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে

স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা

নিয়মিত ব্যায়াম করা

চর্বিযুক্ত খাবার ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলা

অ্যালকোহল সম্পূর্ণ পরিহার করা

শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খাওয়া

ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা

সাধারণ পেটব্যথার ক্ষেত্রে

নিয়মিত সময়ে খাবার খাওয়া

ভাজাপোড়া ও মসলাদার খাবার এড়িয়ে চলা

পর্যাপ্ত পানি পান করা

স্ট্রেস কমানো

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা

উপসংহার

পেটব্যথা আপাতদৃষ্টিতে একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এর পেছনে গুরুতর কারণ লুকিয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে ফ্যাটি লিভারের ব্যথা যদি গ্যাস্ট্রিক বা হজমজনিত ব্যথা ভেবে অবহেলা করা হয়, তবে রোগ দেরিতে ধরা পড়ে এবং জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই যে কোনো পুনরাবৃত্ত বা অস্বাভাবিক পেটব্যথাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। সঠিক সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে ফ্যাটি লিভারসহ অনেক গুরুতর রোগ সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *