থাইরয়েডের গোলযোগে মনের অস্থিরতা: শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যের গভীর যোগসূত্র
আমরা প্রায়ই মানসিক অস্থিরতা, হতাশা, মন খারাপ, কিংবা অযথা রাগারাগিকে জীবনের চাপ, পারিবারিক সমস্যা বা কাজের চাপের ফল ভেবে থাকি। কিন্তু কখনো ভেবেছেন কি, এসব পরিবর্তনের পেছনে শরীরের এক ছোট্ট গ্রন্থি দায়ী হতে পারে? সেই গ্রন্থি হলো থাইরয়েড। গলার সামনে প্রজাপতির মতো আকৃতির এই গ্রন্থিটি শরীরের বিপাকক্রিয়া, শক্তি উৎপাদন, হৃদ্স্পন্দন, ঘুম, এমনকি মনের অবস্থা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এর সামান্য অস্বাভাবিকতাও পুরো শরীর ও মনের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে।
থাইরয়েডের কাজ কী
থাইরয়েড গ্রন্থি দুটি প্রধান হরমোন উৎপাদন করে—থাইরক্সিন (T4) ও ট্রাই–আইডোথাইরোনিন (T3)। এই হরমোনগুলো শরীরের প্রতিটি কোষে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে এবং বিপাকক্রিয়া স্বাভাবিক রাখে। মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত টিএসএইচ (TSH) হরমোন থাইরয়েডকে নির্দেশ দেয় কখন এবং কত পরিমাণে হরমোন তৈরি করতে হবে। কিন্তু কোনো কারণে এই ভারসাম্য নষ্ট হলে দেখা দেয় দুই ধরনের সমস্যা—
হাইপোথাইরয়েডিজম: থাইরয়েড হরমোন কমে যায়।
হাইপারথাইরয়েডিজম: থাইরয়েড হরমোন বেড়ে যায়।
হাইপোথাইরয়েডিজমে মন ও শরীরের পরিবর্তন
হরমোনের মাত্রা কমে গেলে শরীর যেন ধীর হয়ে যায়। এ অবস্থায় মানুষ প্রায়ই অবসাদগ্রস্ত, মনমরা ও উদাসীন হয়ে পড়ে। সহজ কাজও করতে ক্লান্ত লাগে, ঘুম বেশি হয়, মনোযোগ কমে যায়। অনেকে অকারণে কান্নাকাটি বা নেতিবাচক চিন্তায় ভোগেন।
শারীরিকভাবে দেখা দিতে পারে —
ওজন বেড়ে যাওয়া
মুখ ও হাত-পা ফোলা
চুল পড়া ও ত্বক শুষ্ক হওয়া
কোষ্ঠকাঠিন্য
কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে যাওয়া
মাসিক অনিয়ম
গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন চিকিৎসাহীন হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্নতা ও মানসিক অবসাদ বেশি দেখা যায়। অনেক সময় এরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান, কিন্তু মূল সমস্যা থেকে যায় অচিহ্নিত—থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি।
হাইপারথাইরয়েডিজমে মানসিক উত্তেজনা ও অস্থিরতা
অন্যদিকে, যখন থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন শরীরের কার্যক্রম অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত হয়ে ওঠে। হৃদ্স্পন্দন বেড়ে যায়, ঘুম কমে, ক্ষুধা বাড়ে অথচ ওজন কমে যায়। মানসিক দিক থেকে মানুষ হয়ে পড়ে উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন ও সহজে রেগে যাওয়া প্রকৃতির।
এ অবস্থায় অনেকে বলেন, “মনে হয় সারাক্ষণ টেনশন হচ্ছে, ঘুমাতে পারছি না।”
এমনকি গুরুতর ক্ষেত্রে ম্যানিয়া বা মানসিক ভারসাম্যহীনতা পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। চোখ ফুলে যাওয়া বা বড় হয়ে যাওয়া, হাত কাঁপা, এবং মাসিক অনিয়মও সাধারণ উপসর্গ।
থাইরয়েড ও মানসিক স্বাস্থ্য: অদৃশ্য সম্পর্ক
বিজ্ঞানীরা বলছেন, থাইরয়েড হরমোন সরাসরি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার যেমন সেরোটোনিন ও ডোপামিনের ওপর প্রভাব ফেলে। এই রাসায়নিকগুলোই মানুষের মেজাজ, সুখানুভূতি ও মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই থাইরয়েডের অস্বাভাবিকতা মানে হলো মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্যেরও পরিবর্তন—যার ফলেই দেখা দেয় হতাশা, রাগ বা মানসিক ক্লান্তি।
সঠিক পরীক্ষা ও নির্ণয়
থাইরয়েডের সমস্যা নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক সাধারণত রক্তে TSH, T3, T4 পরীক্ষার পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে করা হতে পারে অ্যান্টিবডি টেস্ট, থাইরয়েড আলট্রাসনোগ্রাম বা রেডিওনিউক্লিয়ার ইমেজিং। এসব পরীক্ষায় বোঝা যায় গ্রন্থিটি বেশি কাজ করছে না কম।
চিকিৎসা ও যত্ন
থাইরয়েডের সমস্যার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি, কিন্তু কার্যকর।
হাইপোথাইরয়েডিজমে হরমোনের ঘাটতি পূরণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে থাইরক্সিন ট্যাবলেট খেতে হয়।
হাইপারথাইরয়েডিজমে হরমোন কমানোর ওষুধ, রেডিও–আইডিন থেরাপি বা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে।
ওষুধ কখনো সারা জীবন চলতে পারে, আবার কারও ক্ষেত্রে কিছু সময়ের জন্যই যথেষ্ট।
বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। গর্ভকালীন হরমোনের পরিবর্তনে অনেক নারী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন, যা অনেক সময় থাইরয়েডের ভারসাম্যহীনতার ফল। এ সময় চিকিৎসা না নিলে মা ও শিশুর উভয়ের জন্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
জীবনযাপনে সচেতনতা
থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজন নিয়মিত জীবনযাপন—
সুষম খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম ও নিয়মিত ব্যায়াম
আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার
অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও রাত জাগা এড়িয়ে চলা
বছরে অন্তত একবার থাইরয়েড পরীক্ষা করা (বিশেষ করে নারীদের জন্য)
শেষ কথা
থাইরয়েডের সমস্যা শুধুমাত্র শরীর নয়, মনের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। তাই যদি হঠাৎ করে মন খারাপ, অকারণ ক্লান্তি বা অস্থিরতা টের পান, একে অবহেলা করবেন না। থাইরয়েড পরীক্ষা করান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কারণ, থাইরয়েড ঠিক থাকলে শরীর যেমন সুস্থ থাকে, তেমনি মনও থাকে প্রশান্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ।