শাহজালাল বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডে বিপুল ক্ষতি, ব্যবসায়ীদের লোকসান শত কোটি ডলার

শাহজালাল বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডে বিপুল ক্ষতি, ব্যবসায়ীদের লোকসান শত কোটি ডলার

শাহজালাল বিমানবন্দরের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শত কোটি ডলারের ক্ষতি, রপ্তানি খাত বড় বিপর্যয়ে

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তৈরি পোশাক, কাপড়, ওষুধ, রাসায়নিক পদার্থ ও কাঁচামালসহ বিপুল পরিমাণ পণ্য পুড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এ ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আগুন শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়—বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলেছে।

আগুনের সূত্রপাত ও নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা

গত শনিবার (১৮ অক্টোবর) বেলা আড়াইটার দিকে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটসংলগ্ন কার্গো ভিলেজ হাউস থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশের একাধিক গুদামে। অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো এলাকা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। কার্গো এলাকায় থাকা পণ্যবাহী ট্রাক, কনটেইনার ও প্যাকেটজাত মালামাল আগুনে ভস্মীভূত হয়।

অগ্নিনির্বাপণে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবাহিনীর অন্তত ৩০টি ইউনিট কাজ করে। প্রায় ২৭ ঘণ্টা নিরলস প্রচেষ্টার পর রোববার বিকেল ৫টার দিকে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ৩৫ জন, যাদের বেশিরভাগই ফায়ার সার্ভিস ও নিরাপত্তা কর্মী। সৌভাগ্যক্রমে বড় কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগুন লাগার কারণ এখনো নিশ্চিত নয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কোনো গুদামে থাকা রাসায়নিক পদার্থের বিক্রিয়া বা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।

রপ্তানি খাতে ভয়াবহ প্রভাব

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, আগুনে পুড়ে যাওয়া পণ্যের মধ্যে অনেক ক্রেতার জরুরি অর্ডার ও নতুন স্যাম্পল ছিল। বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন,

“কার্গো ভিলেজে সংরক্ষিত অনেক পণ্য ছিল বড়দিনের বাজারকে লক্ষ্য করে রপ্তানির প্রস্তুতিতে। আগুনে এসব ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য পাঠানো সম্ভব হবে না। এর ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এ খাত থেকে প্রতিবছর প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার আয় হয়, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১০ শতাংশ। এমন অবস্থায় এই অগ্নিকাণ্ড দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক আয়ের উৎসে বড় ধাক্কা এনে দিয়েছে।

কার্গো ভিলেজ: দেশের বাণিজ্যিক লাইফলাইন

শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজটি দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত লজিস্টিক হাবগুলোর একটি। এখানে প্রতিদিন শত শত টন পণ্য আগমন ও প্রেরণ করা হয়। বিশেষ করে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে রপ্তানির জন্য এখানেই পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ হয়।

এই কার্গো ভিলেজে শুধু তৈরি পোশাক নয়—ওষুধ, যন্ত্রপাতি, চামড়াজাত পণ্য, এবং হালকা ইলেকট্রনিক সামগ্রীও সংরক্ষিত থাকে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, ডিসেম্বরে বড়দিনকে সামনে রেখে অক্টোবর মাসে রপ্তানি কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি থাকে। এমন সময় এই অগ্নিকাণ্ড অনেক ব্যবসার ভবিষ্যৎকেও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইইএ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সংস্থাটি সদস্যদের কাছ থেকে ক্ষতির বিস্তারিত তালিকা চেয়েছে, যা বিজিএমইএর মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।

রপ্তানিকারকদের হতাশা ও বিদেশি ক্রেতাদের উদ্বেগ

বিজিএমইএ সদস্য কারখানাগুলোর কয়েকজন মালিক জানিয়েছেন, তাদের প্রস্তুত করা পণ্যের বড় অংশ এই আগুনে পুড়ে গেছে। অনেক ক্রেতা ইতিমধ্যে বিকল্প সরবরাহ উৎস খুঁজতে শুরু করেছেন।

মিরপুরের একটি পোশাক কারখানার মালিক শওকত হোসেন বলেন,

“আমাদের প্রায় ১৫ লাখ টাকার পণ্য ওই কার্গোতে ছিল। সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্রেতাকে এখন কী বলব বুঝতে পারছি না। এমন দুর্ঘটনা আমাদের সুনামকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছে।”

বিদেশি ক্রেতারাও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি পোশাক ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি জানান,

“আমরা বাংলাদেশের উপর নির্ভর করি দ্রুত সরবরাহের জন্য। তবে এমন ঘটনায় সময়সীমা মেনে চলা কঠিন হবে। ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে।”

পরপর তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডে আতঙ্ক

গত এক সপ্তাহে এটি বাংলাদেশের তৃতীয় বড় অগ্নিকাণ্ড। ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে রাসায়নিক গুদামে আগুনে ১৬ জন নিহত হন। দুই দিন পর ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি বহুতল পোশাক কারখানায় আগুন লাগে। এরপর ১৮ অক্টোবরের বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ডে দেশজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।

সামাজিক মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এত অল্প সময়ের ব্যবধানে বড় বড় স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কি কোনো ‘পরিকল্পিত নাশকতা’ আছে? তবে এখন পর্যন্ত সরকার বা তদন্ত সংস্থা এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ পায়নি।

সরকারের পদক্ষেপ ও তদন্ত

অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,

“যদি কোনো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বা নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সরকার ইতিমধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যেখানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা আছেন। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মফিদুর রহমান জানান,

“আমরা ঘটনাস্থলে প্রমাণ সংগ্রহ করছি। কার্গো এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি থাকলে তা চিহ্নিত করে সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও নিরাপত্তা ঘাটতি

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্পাঞ্চল ও গুদাম এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এখনও অপর্যাপ্ত। অনেক স্থাপনায় আধুনিক ফায়ার সেফটি সিস্টেম নেই। কার্গো ভিলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ঘাটতি আছে।

অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শহীদুল ইসলাম বলেন,

“আমরা এখনো প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থায় আছি—আগুন লাগলে নেভাতে যাই, কিন্তু প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই। আগুন লাগলে যেন ক্ষয়ক্ষতি কম হয়, সেজন্য পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি।”

অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অগ্নিকাণ্ড শুধু এককালীন ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা নষ্ট হলে ভবিষ্যতে অর্ডার কমে যেতে পারে।

বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন,

“রপ্তানি খাতের জন্য এটি বড় ধাক্কা। এমন স্থানে অগ্নিকাণ্ড মানে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তা সংস্কৃতি না বদলালে এই ধরনের ঘটনা অর্থনীতিকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”

পুনর্গঠনের দাবি

কার্গো ভিলেজের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও পুনর্নির্মাণে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা চান, ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের আর্থিক সহায়তা ও ব্যাংক ঋণের পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়া হোক।

বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন,

“এখন সবচেয়ে জরুরি হলো ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের পুনরুদ্ধার সহায়তা। সরকার যদি দ্রুত আর্থিক প্রণোদনা দেয়, তাহলে রপ্তানি কার্যক্রম আবার স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে।”

উপসংহার

শাহজালাল বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের রপ্তানি অবকাঠামোর দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম পোশাক রপ্তানিকারক দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যদি অগ্নিকাণ্ডে শত কোটি ডলারের ক্ষতি হয়, তাহলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।

ব্যবসায়ীরা এখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যস্ত, আর সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করছে—এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পেছনের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও দায়ীদের বিচারের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *