কোমরের হাড় সরে যাওয়ার ব্যথা (পিএলআইডি): কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের পূর্ণ গাইড
বর্তমান সময়ে কোমরের ব্যথা আমাদের জীবনের একটি নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। অফিসে বসে দীর্ঘ সময় কাজ করা, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুঁকে থাকা, শারীরিক শ্রমের অভাব—সব মিলিয়ে এখন ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে কোমরব্যথা অন্যতম সাধারণ সমস্যা।
অনেকে সাধারণ পেইনকিলার খেয়ে আরাম পান এবং ভেবে নেন সমস্যা শেষ। কিন্তু বাস্তবে, এই ব্যথার পেছনে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে প্রলাপস লাম্বার ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক (Prolapsed Lumbar Intervertebral Disc), সংক্ষেপে পিএলআইডি (PLID)—যা বাংলায় পরিচিত কোমরের হাড় সরে যাওয়া নামে।
এই রোগে কোমর থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত তীব্র ব্যথা হতে পারে, এমনকি চলাফেরাতেও বাধা সৃষ্টি করে।
পিএলআইডি কী এবং এটি কেন হয়?
আমাদের দেহের মেরুদণ্ড (Spine) হলো ৩৩টি ছোট হাড়ের (কশেরুকা বা Vertebra) একটি শৃঙ্খল, যা মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত। কোমরের নিচের অংশে থাকে পাঁচটি লাম্বার কশেরুকা (L1–L5)। এই কশেরুকাগুলোর মাঝে থাকে ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক—যা মূলত একধরনের নরম কুশন বা প্যাড, যা হাড়গুলোকে একে অপরের সঙ্গে ঘর্ষণ থেকে রক্ষা করে এবং দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে।
প্রতিটি ডিস্কের দুটি স্তর থাকে:
অ্যানুলাস ফাইব্রোসাস (Annulus Fibrosus): শক্ত বাইরের অংশ, যা ডিস্কের গঠন ধরে রাখে।
নিউক্লিয়াস পালপোসাস (Nucleus Pulposus): ভেতরের নরম, জেলির মতো অংশ, যা শক অ্যাবজর্বারের মতো কাজ করে।
যখন কোনো কারণে বাইরের স্তরটি দুর্বল হয়ে যায় বা ছিঁড়ে যায়, তখন ভেতরের নরম অংশটি বাইরে বেরিয়ে আসে এবং পাশের নার্ভ রুটে চাপ সৃষ্টি করে। তখনই আমরা তীব্র কোমরব্যথা, পা অবশ হয়ে যাওয়া, কিংবা হাঁটতে কষ্ট পাওয়ার মতো উপসর্গ অনুভব করি।
কোমরের হাড় সরে যাওয়ার প্রধান কারণগুলো
পিএলআইডি হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। নিচে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো উল্লেখ করা হলো— ভুল ভঙ্গিতে ভারী বস্তু তোলা
হঠাৎ করে নিচু হয়ে ভারী কিছু তুললে ডিস্কে প্রচণ্ড চাপ পড়ে, ফলে সেটি ছিঁড়ে যেতে পারে।
দীর্ঘ সময় বসে থাকা
অফিসের কাজ, গাড়ি চালানো বা মোবাইল–কম্পিউটারে কাজ করার সময় টানা বসে থাকা কোমরের ডিস্কে দীর্ঘমেয়াদি চাপ তৈরি করে।
দুর্ঘটনা বা হঠাৎ আঘাত
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, পড়ে যাওয়া, হঠাৎ শরীর বাঁকানো বা ভারসাম্য হারানোয় কোমরে আঘাত লাগে, যা ডিস্ক ফাটিয়ে দিতে পারে।
বয়সজনিত ক্ষয়
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিস্কের নমনীয়তা ও স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়, ফলে ফাটার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ওজন বৃদ্ধি
অতিরিক্ত ওজন কোমরের নিচের অংশে স্থায়ী চাপ সৃষ্টি করে, যা ডিস্ক দুর্বল করে।
মাংসপেশি দুর্বলতা
কোর (Core) মাংসপেশি দুর্বল হলে মেরুদণ্ডের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
ধূমপান
ধূমপানের ফলে ডিস্কে রক্ত চলাচল কমে যায়, পুষ্টির অভাব হয়, এবং দ্রুত ক্ষয় হয়।
পিএলআইডির লক্ষণ ও উপসর্গ
পিএলআইডির উপসর্গ অনেক সময় ধীরে ধীরে শুরু হয়, আবার কখনো হঠাৎ করেও হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ লক্ষণ তুলে ধরা হলো—
কোমরের নিচে তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়া
ব্যথা এক বা দুই পায়ে নেমে যাওয়া (সায়াটিকা পেইন)
পায়ে ঝিনঝিনি, অবশ বা জ্বালাভাব
হাঁটতে বা দাঁড়াতে কষ্ট হওয়া
পিঠ বাঁকা হয়ে যাওয়া বা একদিকে হেলে থাকা
হাঁচি–কাশিতে ব্যথা বেড়ে যাওয়া
বসে থেকে দাঁড়াতে কষ্ট হওয়া
গুরুতর অবস্থায় প্রস্রাব–পায়খানা নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা (Cauda Equina Syndrome)
এই উপসর্গগুলো অবহেলা করলে সময়ের সঙ্গে আরও জটিল হতে পারে।
পিএলআইডি কীভাবে নির্ণয় করা হয়
চিকিৎসক প্রথমে রোগীর ইতিহাস, ব্যথার ধরণ ও শারীরিক পরীক্ষা করেন। এরপর কিছু বিশেষ পরীক্ষা করা হয়—
এক্স-রে (X-ray): মেরুদণ্ডের কাঠামোগত অবস্থার ধারণা দেয়।
এমআরআই (MRI): সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, যা ডিস্ক কতটা সরে গেছে বা নার্ভে কত চাপ পড়েছে তা নির্ধারণ করে।
সিটি স্ক্যান (CT Scan): ডিস্কের বিস্তারিত গঠন ও আশপাশের হাড়ের অবস্থা বোঝার জন্য।
স্নায়ু পরীক্ষা (Nerve conduction test): নার্ভের কার্যকারিতা মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি
পিএলআইডির চিকিৎসা নির্ভর করে সমস্যার মাত্রা, বয়স এবং শারীরিক অবস্থার ওপর। সাধারণভাবে তিনভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়—
ওষুধ ও বিশ্রাম
প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসক ব্যথানাশক, প্রদাহনাশক ও মাংসপেশি শিথিলকারী ওষুধ দিতে পারেন। বিশ্রাম নেওয়া জরুরি, তবে একেবারে বিছানায় শুয়ে থাকা নয়—হালকা চলাফেরা বজায় রাখা দরকার।
ফিজিওথেরাপি
ফিজিওথেরাপি হলো পিএলআইডির সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসা। এটি ব্যথার মূল কারণেই কাজ করে এবং নার্ভের ওপর চাপ কমায়।
জনপ্রিয় কিছু ফিজিওথেরাপি পদ্ধতি
ব্যাক এক্সটেনশন এক্সারসাইজ (McKenzie Exercises)
কোর স্ট্রেনদেনিং (Core Strengthening) ব্যায়াম
ইলেকট্রোথেরাপি (TENS, Ultrasound, Shortwave Diathermy)
ম্যানুয়াল থেরাপি ও মবিলাইজেশন টেকনিক
স্ট্রেচিং ও পেশি রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজ
ফিজিওথেরাপি শুধু ব্যথা কমায় না, এটি ভবিষ্যতে ডিস্ক পুনরায় সরে যাওয়ার ঝুঁকিও কমায়।
অস্ত্রোপচার
সব রোগীর সার্জারি প্রয়োজন হয় না। তবে নিচের পরিস্থিতিতে অস্ত্রোপচার করা জরুরি হয়—
ওষুধ ও থেরাপিতে ব্যথা না কমলে
নার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হলে
প্রস্রাব বা পায়খানা নিয়ন্ত্রণ হারালে
চলাফেরায় মারাত্মক সমস্যা হলে
বর্তমানে মাইক্রোডিসেকটমি ও এন্ডোস্কোপিক ডিস্ক সার্জারি নামে অত্যাধুনিক ও কম ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করা হয়।
দৈনন্দিন জীবনে করণীয়
পিএলআইডি থেকে বাঁচতে বা চিকিৎসার পর পুনরায় সমস্যা এড়াতে কিছু নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি—
ভারী কিছু তুলতে হলে হাঁটু ভাঁজ করে তুলুন, কোমর ঝুঁকাবেন না।
দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে মাঝেমধ্যে উঠে হাঁটুন।
নরম বিছানায় নয়, শক্ত বিছানায় ঘুমান।
পিঠ সোজা রেখে বসুন এবং চেয়ার ব্যবহারে লাম্বার সাপোর্ট ব্যবহার করুন।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণ বন্ধ করুন।
ব্যায়ামকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ করুন—বিশেষ করে কোর মাংসপেশি শক্ত করার ব্যায়াম।
ঘরোয়া যত্ন ও লাইফস্টাইল টিপস
সকালে ও বিকেলে হালকা হাঁটুন।
ব্যথার জায়গায় গরম পানির সেঁক দিন।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন, ডিস্কের নমনীয়তা বজায় রাখতে এটি জরুরি।
বেশি সময় এক ভঙ্গিতে মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহার করবেন না।
মানসিক চাপ কমান, কারণ স্ট্রেস মাংসপেশিকে টানটান করে ব্যথা বাড়াতে পারে।
সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন: কোমরের ব্যথা মানেই কি পিএলআইডি?
উত্তর: না, সব কোমরব্যথা পিএলআইডি নয়। এটি হতে পারে পেশি টান, আর্থ্রাইটিস, বা লিগামেন্ট ইনজুরির কারণেও। তবে ব্যথা যদি পায়ে নেমে যায়, তখন এটি পিএলআইডির ইঙ্গিত হতে পারে।
প্রশ্ন: ফিজিওথেরাপি কি স্থায়ী সমাধান দেয়?
উত্তর: হ্যাঁ, প্রাথমিক ও মাঝারি পর্যায়ের পিএলআইডিতে ফিজিওথেরাপি ৮০–৯০% ক্ষেত্রে স্থায়ী সমাধান দেয়।
প্রশ্ন: পিএলআইডিতে কি ব্যায়াম করা নিরাপদ?
উত্তর: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যেকোনো ব্যায়াম বিপজ্জনক হতে পারে। তবে ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শে নির্দিষ্ট ব্যায়াম খুবই উপকারী।
প্রশ্ন: অস্ত্রোপচারের পর কি স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ, বর্তমানে আধুনিক সার্জারিতে রোগীরা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।
উপসংহার
পিএলআইডি বা কোমরের হাড় সরে যাওয়া কোনো অপ্রতিরোধ্য রোগ নয়। সচেতনতা, নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গি এবং দ্রুত চিকিৎসা নিলেই এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
মনে রাখুন—
“আপনার মেরুদণ্ডই শরীরের প্রধান স্তম্ভ। একে যত্ন না নিলে পুরো দেহ ভেঙে পড়বে।”
তাই কোমরে ব্যথা হলে অবহেলা করবেন না, কারণ সামান্য অসাবধানতাই পরবর্তীতে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন, সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন, আর জীবনকে রাখুন ব্যথামুক্ত ও প্রাণবন্ত।