টাইফয়েড টিকা না নিলে শিশুর কী ঝুঁকি হতে পারে

টাইফয়েড টিকা না নিলে শিশুর কী ঝুঁকি হতে পারে

শিশুদের টাইফয়েড টিকা: কেন এখনই নেওয়া জরুরি

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশে এখনো টাইফয়েড জ্বর একটি ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতি বছর লাখ লাখ শিশু এ রোগে আক্রান্ত হয়, অনেকের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে। অথচ এই মারাত্মক ব্যাধি প্রতিরোধ করা সম্ভব একটি ছোট্ট টিকার মাধ্যমেই।

 টাইফয়েড জ্বর কীভাবে হয়

টাইফয়েড জ্বরের মূল কারণ সালমোনেলা টাইফি (Salmonella Typhi) নামের একটি ব্যাকটেরিয়া। এই জীবাণু সাধারণত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। অপরিষ্কার পরিবেশ, নোংরা হাত, অপরিষ্কার বাসনপত্র, এবং সঠিকভাবে রান্না না করা খাবার টাইফয়েড ছড়ানোর মূল বাহন।

একবার সংক্রমণ হলে ব্যাকটেরিয়াটি রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়।

টাইফয়েডের লক্ষণ ও জটিলতা

প্রথম দিকে টাইফয়েডের উপসর্গ সাধারণ জ্বরের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ জ্বর (১০২–১০৪°F পর্যন্ত)

পেটব্যথা, বমি, ও ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য

মাথাব্যথা ও অবসাদ

ক্ষুধামান্দ্য ও ওজন কমে যাওয়া

কখনো কখনো চামড়ায় লালচে ফুসকুড়ি দেখা যায়

যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তবে অন্ত্রে ছিদ্র (intestinal perforation), মস্তিষ্কের প্রদাহ (encephalopathy), এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে

টাইফয়েড টিকা কীভাবে কাজ করে

টাইফয়েড প্রতিরোধে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV)।
এটি একটি আধুনিক সাব–ইউনিট টিকা, যেখানে ব্যাকটেরিয়ার একাংশকে প্রোটিন ক্যারিয়ারের সঙ্গে যুক্ত করে তৈরি করা হয়।

এই টিকা শরীরে দীর্ঘমেয়াদি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, যা আগের টিকার তুলনায় বেশি কার্যকর ও নিরাপদ।
এটি মাংসপেশিতে ইনজেকশন আকারে দেওয়া হয় এবং সাধারণত এক ডোজেই যথেষ্ট সুরক্ষা পাওয়া যায়, যা প্রায় তিন বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

কেন টিকা নেওয়া জরুরি

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে টাইফয়েডের সংক্রমণ হার সবচেয়ে বেশি।
তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলক কম হওয়ায় তারা সহজেই আক্রান্ত হয়।

টিকা নেওয়ার উপকারিতা:

মারাত্মক টাইফয়েড ও তার জটিলতা (অন্ত্রে ছিদ্র, মস্তিষ্কের প্রদাহ) প্রতিরোধ করে।

অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী টাইফয়েডের বিস্তার রোধে সহায়তা করে।

জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ কমায় এবং চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস করে।

স্কুলগামী শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা থেকে রক্ষা করে।

বাংলাদেশের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি

২০২৫ সালের ১২ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে।
এই কর্মসূচির আওতায় ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী প্রায় পাঁচ কোটি শিশু-কিশোরকে বিনামূল্যে টিসিভি টিকা দেওয়া হচ্ছে।

এই টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) স্বীকৃত ও সুপারিশকৃত। অর্থাৎ এটি কোনো পরীক্ষামূলক বা ট্রায়াল ভ্যাকসিন নয়—এর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা বিশ্বজুড়ে প্রমাণিত।

 কাদের জন্য টিকা বেশি প্রয়োজন

৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সব শিশু ও কিশোর

যারা শহর, বস্তি, বা পানি দূষিত এলাকায় বাস করে

যারা স্কুল, ডে-কেয়ার বা হোস্টেলে একসঙ্গে থাকে

দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু

১৫ বছরের বেশি বয়সীরা চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে টিকা নিতে পারেন।

 কারা টিকা নিতে পারবে না

যাদের বর্তমানে জ্বর (১০০°F এর বেশি) রয়েছে

পূর্বে কোনো টিকায় মারাত্মক অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল

৯ মাসের কম বয়সী শিশু

অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী মা (চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া)

 বিশেষজ্ঞদের মতামত

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, “টাইফয়েড টিকা পুরোপুরি নিরাপদ। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি শিশু এই টিকা গ্রহণ করেছে এবং কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, যেখানে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি চালু হয়েছে, সেখানে শিশুদের মধ্যে টাইফয়েড সংক্রমণ ৭০–৮০% পর্যন্ত কমে গেছে।

 টিকার পর সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

টাইফয়েড টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত হালকা ও সাময়িক, যেমন—

টিকা দেওয়ার স্থানে সামান্য ব্যথা, লালচে দাগ বা ফুলে যাওয়া

অল্প জ্বর বা মাথাব্যথা

অস্থায়ী ক্লান্তি বা ঘুম ভাব

এসব উপসর্গ ২৪–৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিজে থেকেই চলে যায়।

প্রতিরোধে দৈনন্দিন অভ্যাস

টিকার পাশাপাশি নিয়মিত কিছু অভ্যাসও টাইফয়েড প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—

ফুটানো পানি বা নিরাপদ বোতলজাত পানি পান করা

রাস্তার খাবার ও অপরিষ্কার ফলমূল এড়িয়ে চলা

খাওয়ার আগে ও টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া

শিশুদের স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শিক্ষা দেওয়া

খাবার ভালোভাবে রান্না করা এবং ঢেকে রাখা

 উপসংহার

টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধযোগ্য, কিন্তু চিকিৎসা না পেলে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।
একটি ছোট্ট টিকা শিশুকে শুধু টাইফয়েড থেকে নয়, ভবিষ্যতের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের হুমকি থেকেও রক্ষা করে।

তাই অভিভাবকদের উচিত সময়মতো টিকা দিয়ে সন্তানের সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।
টাইফয়েড টিকা শুধু সুরক্ষা নয়—এটি শিশুর প্রতি আপনার দায়িত্বের প্রতীক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *