দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাকে পদত্যাগের পরামর্শ, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে নতুন টানাপোড়েন
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনের দুই মাসের মাথায় উপদেষ্টা পরিষদের ভেতরে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে সরে না গিয়ে আরও সময় নিতে চেয়েছেন। এই ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে—সরকারের অভ্যন্তরে কি মতপার্থক্য বাড়ছে?
পদত্যাগের পরামর্শ ও উপদেষ্টাদের প্রতিক্রিয়া
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর দাবি, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া–কে মৌখিকভাবে পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে দুই উপদেষ্টাই সময় চেয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, এখনই পদত্যাগ করলে ছাত্র সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে।
সূত্র জানায়, মাহফুজ আলম নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো আগ্রহ দেখাননি। তিনি সরকারে থেকে দায়িত্ব পালন চালিয়ে যেতে চান। অন্যদিকে আসিফ মাহমুদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে পদত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
দুজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে আসিফ মাহমুদ গত ১৪ আগস্ট সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, “নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আমি পদত্যাগ করব।”
অন্যদিকে মাহফুজ আলম ২৮ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেন, “দুই মাস ধরে আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি—আমি কখন নামব, আমি জানি না।”
অন্তর্বর্তী সরকারের পটভূমি ও গঠন:
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টাসহ মোট ২৩ জন সদস্য এই পরিষদে রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি। এই দুই ছাত্র উপদেষ্টা সরকারের তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।
সরকার গঠনের সময় ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন মো. নাহিদ ইসলাম, যিনি জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব দেন। তবে তিনি ২৫ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেন। এনসিপি গঠিত হয় গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে।
নাহিদ ইসলামের পদত্যাগের পর উপদেষ্টা পরিষদে নতুন করে জায়গা পান মাহফুজ আলম, যিনি শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ছিলেন এবং পরে ১০ নভেম্বর উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। নাহিদ ইসলামের পদ ছাড়ার পর তাঁকে তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অন্যদিকে আসিফ মাহমুদ শুরুতে শ্রম ও যুব–ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। পরে প্রয়াত এ এফ হাসান আরিফের স্থলাভিষিক্ত হয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এবং বর্তমানে তিনি স্থানীয় সরকার ও ক্রীড়া—দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
ছাত্র উপদেষ্টাদের অবস্থান ও আশঙ্কা:
সরকারি সূত্রের মতে, ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টারা চান যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তত একজন ছাত্র প্রতিনিধি থাকুক। তাঁদের ধারণা, যদি কেউ না থাকে, তাহলে উপদেষ্টা পরিষদের কিছু প্রভাবশালী সদস্য তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারেন।
একজন ছাত্র উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠজন বলেন, “আমরা চাই সরকারে তরুণদের কণ্ঠ বজায় থাকুক। না হলে যে রাজনৈতিক ঐক্যের কথা বলা হয়েছিল, তা দুর্বল হয়ে যাবে।”
এনসিপির ভূমিকা ও বিতর্ক:
রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, এই দুই উপদেষ্টা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)–র ঘনিষ্ঠ। তাঁরা দলটির নীতি নির্ধারণ ও যোগাযোগে অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত।
১৪ অক্টোবর রাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে একজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টার উপস্থিতি এই সন্দেহ আরও জোরদার করেছে।
তবে এনসিপি নেতারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় বিভিন্ন দলের কাছ থেকে নাম নেওয়া হয়েছিল। কেবল ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাদের সরে যেতে বলা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।”
এনসিপির নেতারা এ বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকেও তুলেছেন বলে জানা গেছে।
উপদেষ্টা পরিষদের অভ্যন্তরীণ মতভেদ:
অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে উপদেষ্টা পরিষদের ভেতরে দলীয় লিয়াজোঁ, প্রভাব ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ভেতরকার উত্তেজনা বাড়ছে।
বিএনপি প্রকাশ্যে দাবি করেছে—সরকারের কিছু উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের অভিযোগ করেছেন, কিছু উপদেষ্টা গোপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ:
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, উপদেষ্টা পরিষদকে ঘিরে যেসব বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, তা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
তিনি বলেন,
“এই মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি। যদি ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে জনগণের আস্থা নষ্ট হবে।”
তিনি আরও বলেন,
“দুই ছাত্র উপদেষ্টার উচিত স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া—তাঁরা নির্বাচন করবেন না, এবং এনসিপির সঙ্গে কোনো প্রকাশ্য বা গোপন সম্পর্ক নেই। অন্যথায় তাঁদের পদত্যাগ করা উচিত।”
নির্বাচনী প্রেক্ষাপট:
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে নির্বাচন কমিশনের সূত্র জানিয়েছে।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ এখন রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতরে অস্থিরতা, পদত্যাগের আলোচনা, আর দলীয় সংযোগের অভিযোগ—সব মিলিয়ে সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
উপসংহার:
অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুটা ছিল আশাব্যঞ্জক—জনগণ চেয়েছিল একটি নিরপেক্ষ, সাহসী ও সংস্কারধর্মী প্রশাসন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিষদের ভেতরে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং পদত্যাগের চাপ সরকারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ও রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করা।
দুই ছাত্র উপদেষ্টার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত তাই শুধু তাঁদের ব্যক্তিগত নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।