ভিটামিন ডি পেতে কখন, কীভাবে ও কতটুকু রোদ লাগাতে হবে
শরীর ও মনের সুস্থতায় সূর্যের আলো কেন অপরিহার্য
আমরা সবাই জানি—সূর্য ছাড়া পৃথিবীতে জীবন অসম্ভব। কিন্তু জানেন কি, শুধু আলো বা তাপ নয়, সূর্য আমাদের শরীরে এক অনন্য ভিটামিন তৈরি করে, যার অভাবে নানান রোগে ভুগতে হয়?
এটি হলো ভিটামিন ডি, যাকে ভালোবেসে বলা হয় ‘সানশাইন ভিটামিন’।
ভিটামিন ডি আসলে কী করে?
ভিটামিন ডি হলো এক বিশেষ ধরনের ফ্যাট-সলিউবল ভিটামিন, যা আমাদের দেহে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় কাজ করে।
এর প্রধান কাজ হলো—
রক্তে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা ঠিক রাখা
হাড়, দাঁত ও পেশি মজবুত রাখা
ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করা
মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কার্যক্রম ঠিক রাখা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ ভিটামিন ডির ঘাটতিতে ভোগেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি—বিশেষ করে শহুরে জীবনযাপনকারী মানুষদের মধ্যে।
শরীরে ভিটামিন ডি তৈরির প্রক্রিয়া
যখন সূর্যের আলোয় থাকা UVB রশ্মি আমাদের ত্বকে পড়ে, তখন ত্বকের কোলেস্টেরল থেকে প্রোভিটামিন ডি৩ তৈরি হয়।
এই উপাদানটি রক্তে মিশে লিভার ও কিডনিতে যায় এবং রূপ নেয় সক্রিয় ভিটামিন ডি (ক্যালসিট্রিয়ল)-এ।
এটি এরপর শরীরের কোষে ক্যালসিয়াম শোষণ, হাড় গঠন ও রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
এক কথায়—
“রোদ ত্বকের জন্য নয়, বরং শরীরের ভেতরের ভিটামিন কারখানার চাবি।”
কখনের রোদ সবচেয়ে উপকারী?
বিশেষজ্ঞরা বলেন,
“যখন নিজের ছায়া নিজের উচ্চতার চেয়ে ছোট দেখবেন, সেই সময়ের রোদই সবচেয়ে কার্যকর।”
অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ৩টার মধ্যে রোদে থাকা সবচেয়ে ভালো।
এই সময় UVB রশ্মি সবচেয়ে সক্রিয় থাকে এবং ত্বক থেকে দ্রুত ভিটামিন ডি তৈরি হয়।
কতক্ষণ রোদে থাকা উচিত?
সপ্তাহে ৩–৪ দিন
প্রতিদিন ১০–৩০ মিনিট করে
যতটা সম্ভব ত্বকের খোলা অংশে রোদ লাগানো উচিত—যেমন হাত, পা, মুখ ও ঘাড়
অবশ্যই রোদে থাকার সময় ভারী পোশাক বা ছাতা ব্যবহার না করাই ভালো।
ত্বকের রঙ ও বয়সের সঙ্গে পার্থক্য
ত্বকের রঙ নির্ভর করে মেলানিন নামক উপাদানের ওপর।
গাঢ় ত্বকে মেলানিন বেশি থাকায় UVB রশ্মি ভেতরে পৌঁছাতে সময় লাগে।
তাই—
ফর্সা ত্বক: ১০–১৫ মিনিট যথেষ্ট
শ্যামলা বা গাঢ় ত্বক: ৩০–৪৫ মিনিট পর্যন্ত রোদে থাকা দরকার
বয়স্ক ও শিশু: তাদের ত্বকের প্রতিক্রিয়া কম, তাই সামান্য বেশি সময় রোদে থাকা উচিত
বিশেষজ্ঞের মত
ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুষ্টিবিদ ডা. সেলিনা পারভীন বলেন—
“শরীরে তৈরি হওয়া ভিটামিন ডি চর্বি কোষে সঞ্চিত থাকে, তবে সেটা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর থাকে না। তাই নিয়মিত রোদে থাকা দরকার। একদিন বেশি রোদে থাকলে বছরের ঘাটতি পূরণ হয় না।”
তিনি আরও বলেন,
“যারা ঘরের ভেতর কাজ করেন, কাচের জানালার পাশে বসে থাকেন বা সবসময় সানস্ক্রিন ব্যবহার করেন, তারা ঝুঁকিতে থাকেন। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন সকাল ১১টার দিকে ২০ মিনিট রোদে থাকা উচিত।”
সানস্ক্রিন ও পোশাকের ভূমিকা
UVB রশ্মি ব্লক করে এমন সানস্ক্রিন (SPF ৩০ বা তার বেশি) ব্যবহার করলে ত্বকে ভিটামিন ডি তৈরির ক্ষমতা প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
তাই মাঝে মাঝে, বিশেষ করে সকালে বা বিকেলে, সানস্ক্রিন ছাড়া রোদে থাকা দরকার।
একইভাবে, ঘরের কাচের জানালার ভেতর দিয়ে আসা আলোতেও UVB রশ্মি পৌঁছায় না।
অর্থাৎ—ঘরে বসে রোদ পেলেও ভিটামিন ডি পাওয়া যায় না!
খাবারে ভিটামিন ডির উৎস
রোদে না গেলে কিছু খাবার থেকেও সীমিত পরিমাণ ভিটামিন ডি পাওয়া সম্ভব—
খাবার ভিটামিন ডির পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রাম)
স্যামন মাছ ৫২৬ IU
সার্ডিন ২৭২ IU
ডিমের কুসুম ৩৭ IU
দুধ ও দই (ফর্টিফায়েড) ১০০ IU
মাশরুম ১৩০ IU
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোদ ছাড়া শুধু খাবার দিয়ে দৈনিক চাহিদা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব।
ভিটামিন ডি ঘাটতির লক্ষণ
ভিটামিন ডির অভাবে শরীরে নানা পরিবর্তন দেখা দেয়—
হাড় ও জোড়ায় ব্যথা
বারবার সর্দি-কাশি
সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়া
পেশিতে দুর্বলতা
ঘুমে সমস্যা
মেজাজ খিটখিটে বা বিষণ্নতা
শিশুদের ক্ষেত্রে এটি রিকেটস (হাড় বাঁকা হয়ে যাওয়া) তৈরি করতে পারে, আর বয়স্কদের মধ্যে দেখা দেয় অস্টিওপরোসিস বা হাড় ভাঙার প্রবণতা।
সাপ্লিমেন্টের প্রয়োজন ও সতর্কতা
যদি রোদে থাকা সম্ভব না হয় বা খাবার থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি না মেলে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে।
তবে নিজে থেকে সাপ্লিমেন্ট খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ—
“অতিরিক্ত ভিটামিন ডি শরীরে ক্যালসিয়ামের মাত্রা অতিরিক্ত বাড়িয়ে কিডনি ও হৃদ্যন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে।”
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক গড় চাহিদা ৬০০–৮০০ IU।
কিন্তু কারও ঘাটতি থাকলে চিকিৎসক রক্তপরীক্ষা করে উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ করেন।
রোদে থাকার মানসিক উপকারিতা
রোদ শুধু শরীর নয়, মনকেও সুস্থ রাখে।
সূর্যের আলো মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক হরমোন বাড়ায়, যা মুড উন্নত করে এবং উদ্বেগ কমায়।
তাই মন খারাপ লাগলে সকালে কিছু সময় খোলা রোদে হাঁটলে মনের প্রশান্তি বাড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রোদে থাকা মানুষদের মধ্যে বিষণ্নতা ৪০% কম দেখা যায়।
রোদ না থাকলে কী করবেন?
বর্ষাকাল বা শীতকালে অনেক সময় সূর্যের আলো কম পাওয়া যায়। তখন—
রোদে শুকানো খাবার খান (বিশেষ করে মাশরুম)
ফর্টিফায়েড দুধ ও সিরিয়াল খাওয়ার অভ্যাস করুন
সপ্তাহে একবার বাইরে খোলা আকাশের নিচে হাঁটুন
প্রয়োজনে ডাক্তারি পরামর্শে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নিন
শেষ কথা
ভিটামিন ডি কোনো বিলাসিতা নয়—এটি শরীরের এক মৌলিক চাহিদা।
তাই ব্যস্ততা, ভয় বা গায়ের রঙের চিন্তা না করে প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য রোদে থাকুন।
“রোদে থাকা মানেই সুস্থ থাকা—মন, হাড় ও হৃদয়—সবকিছুর জন্য।”
রোদকে ভয় নয়, বন্ধু বানান।
প্রতিদিন একটু রোদ মেখে নিন, আর অনুভব করুন প্রাকৃতিক শক্তির আশ্চর্য উপহার