ব্রেন ফগ: যখন মস্তিষ্ক কাজ করে ধীরে—রাখো এই ৭টি অভ্যাস

ব্রেন ফগ: যখন মস্তিষ্ক কাজ করে ধীরে—রাখো এই ৭টি অভ্যাস

হঠাৎ ভুলে যাচ্ছেন? হতে পারে ‘ব্রেন ফগ’ — জানুন এর কারণ, লক্ষণ ও সমাধান

লিড:
আজকাল অনেকেই অভিযোগ করেন—“ঘরে ঢুকেছি কিছু নিতে, কিন্তু কী নিতে এসেছিলাম মনে নেই!”, “কথা বলার মাঝপথে থেমে যাই, বাক্যটা শেষ করতে পারি না।”
এই ছোট ভুলগুলো কখনো কখনো হাসির খোরাক হলেও, এগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে এক বাস্তব মানসিক সমস্যা—‘ব্রেন ফগ’ বা মস্তিষ্কের ধোঁয়াশা।

 ‘ব্রেন ফগ’—নামটা শুনে কুয়াশার মতোই অস্পষ্ট মনে হয়

যেমন ঘন কুয়াশায় দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, তেমনি ব্রেন ফগে চিন্তাশক্তি, মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি সবকিছু কিছুটা ঝাপসা হয়ে পড়ে।
আপনি হয়তো সহজ কোনো কাজ করতে যাচ্ছেন, কিন্তু হঠাৎ বুঝতে পারছেন, কী করতে যাচ্ছিলেন তা মনে নেই।
এটি মস্তিষ্কের ক্লান্তি বা মানসিক চাপের একটি প্রতিক্রিয়া, যা সাময়িক হলেও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে—কাজের দক্ষতা থেকে শুরু করে সম্পর্ক ও মানসিক সুস্থতা পর্যন্ত।

কেন হয় ব্রেন ফগ: কারণগুলো গভীরভাবে বুঝে নেওয়া যাক
  ঘুমের অভাব

ঘুম কেবল বিশ্রাম নয়, এটি মস্তিষ্কের “মেইনটেন্যান্স টাইম।” ঘুমের সময়ই মস্তিষ্ক দিনের তথ্য সাজিয়ে নেয়, স্মৃতি গুছিয়ে রাখে।
একটানা কয়েকদিন ঘুম কম হলে নিউরনের মধ্যে যোগাযোগ দুর্বল হয়ে যায়, ফলে চিন্তা ধীর হয়, মনোযোগ বিচ্যুত হয়।

 মানসিক চাপ ও উদ্বেগ

স্ট্রেস বা উদ্বেগের সময় শরীর কর্টিসল নামের হরমোন নিঃসরণ করে। সাময়িকভাবে এটি মনোযোগ বাড়ালেও দীর্ঘমেয়াদে কর্টিসল মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অংশে প্রভাব ফেলে—যেখানে স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে।
ফলে তথ্য মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

 অনিয়মিত জীবনধারা

অতিরিক্ত ক্যাফেইন, জাঙ্ক ফুড, রাতজাগা জীবন ও অনিয়মিত খাবারের কারণে রক্তে শর্করার ওঠানামা হয়। এতে মস্তিষ্কে গ্লুকোজ সরবরাহ ব্যাহত হয়, আর সেই মুহূর্তেই চিন্তা-ভাবনায় ঝাপসা ভাব আসে।

পানিশূন্যতা ও পুষ্টির ঘাটতি

মানুষের শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশ পানি, অথচ অনেকে দিনের বেশিরভাগ সময় একফোঁটাও পানি না খেয়ে কাটিয়ে দেন।
সামান্য পানিশূন্যতাও মনোযোগ কমিয়ে দিতে পারে।
তাছাড়া ভিটামিন বি১২, আয়রন, ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাবেও ব্রেন ফগ দেখা দিতে পারে।

অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম

ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল, ট্যাব বা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ ও মস্তিষ্ককে একসঙ্গে ক্লান্ত করে ফেলে।
এর সঙ্গে ঘুমের ঘাটতি ও নীল আলোর প্রভাব যোগ হয়ে মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক ছন্দ নষ্ট করে দেয়।

শারীরিক অসুস্থতা ও হরমোন পরিবর্তন

থাইরয়েড সমস্যা, ডায়াবেটিস, কোভিড–পরবর্তী ক্লান্তি, বা মেনোপজের সময় হরমোনের তারতম্যও ব্রেন ফগের একটি বড় কারণ।

কীভাবে বুঝবেন আপনি ব্রেন ফগে আক্রান্ত

প্রায়ই সহজ বিষয় ভুলে যাচ্ছেন

কথার মাঝখানে থেমে যাচ্ছেন

কাজের সময় মনোযোগ হারাচ্ছেন

মানসিকভাবে ক্লান্ত বা ঝিমিয়ে পড়ছেন

সকালে ঘুম থেকে উঠে সতেজ লাগছে না

নতুন কিছু শেখার আগ্রহ হারাচ্ছেন

যদি এসব উপসর্গ নিয়মিত দেখা দেয়, তবে এটিকে ‘সাধারণ ক্লান্তি’ ভেবে উপেক্ষা করা ঠিক নয়।

 ব্রেন ফগ থেকে মুক্তির বৈজ্ঞানিক কৌশল
 নিজের প্রতি সদয় হোন

বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রেন ফগ আপনার ব্যর্থতা নয়, বরং আপনার মস্তিষ্কের একটি সিগন্যাল—”আমি বিশ্রাম চাই।”
তাই নিজেকে দোষ না দিয়ে ধীরে চলুন।
কাজ ভাগ করে দিন, প্রয়োজনে সহকর্মী বা পরিবারের সাহায্য নিন।

 নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করুন

যখন দিনটা নির্দিষ্ট কাঠামোয় চলে, তখন মস্তিষ্ককে বারবার সিদ্ধান্ত নিতে হয় না—ফলে চিন্তার ভার কমে।
সকাল-বিকেল রুটিন তৈরি করুন।
আগের রাতে পোশাক গুছিয়ে রাখুন, নাশতা ও কাজের সময় ঠিক করে রাখুন।

 বিরতি নিন—‘ব্রেন ব্রেক’ খুব জরুরি

একটার পর একটা কাজ করতে করতে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
প্রতি এক ঘণ্টা পর অন্তত ৫–১০ মিনিট বিরতি নিন। জানালা খুলে বাতাস নিন, পানি খান, চোখ বন্ধ করে শ্বাস-প্রশ্বাসে মন দিন।
এই ছোট বিরতিগুলোই ব্রেন ফগ প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে।

 প্রযুক্তিকে সহযোগী করুন

সবকিছু মনে রাখার চেষ্টা করে মস্তিষ্ককে বোঝা দেবেন না। ক্যালেন্ডার, রিমাইন্ডার, নোটপ্যাড—এই সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করুন। এতে মস্তিষ্কের ওপর চাপ কমে, আর ভুলে যাওয়ার প্রবণতাও কমে যায়।

 ‘SWANS’ পদ্ধতি অনুসরণ করুন

বিবিসি ওয়ানের চিকিৎসক ডা. থারাকা ব্রেন ফগ দূর করার একটি সহজ ফর্মুলা দিয়েছেন, যা হল SWANS:

SSleep (ঘুম): নিয়মিত ৭–৯ ঘণ্টা ঘুম।

Water (পানি): সারাদিন পর্যাপ্ত পানি পান।

Activity (সক্রিয়তা): প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম।

Nutrition (পুষ্টি): প্রাকৃতিক খাবার, ফল, শাকসবজি ও বাদাম খাওয়া।

Stress (চাপ): ধ্যান, গান, বা শখের কাজে সময় দিন।

এই ৫টি বিষয়কে জীবনের অংশ করতে পারলে মস্তিষ্কে পরিষ্কারভাব ফিরে আসে, চিন্তা হয় দ্রুত, আর মন থাকে স্থির।

মস্তিষ্কের যত্নে দৈনন্দিন অভ্যাস

 প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট ধ্যান করুন

সকালে সূর্যের আলোতে কিছুক্ষণ হাঁটুন

 শোয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করুন

প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন

 প্রিয় কাজে মন দিন—রান্না, আঁকা, বই পড়া বা বাগান করা

শেষ কথা

‘ব্রেন ফগ’ কোনো ভয়ংকর রোগ নয়, কিন্তু এটি আপনার শরীরের সতর্কবার্তা—“ধীরে চলো, আমি ক্লান্ত।”
আমরা যত ব্যস্তই থাকি না কেন, মস্তিষ্কের যত্ন নেওয়া ভুলে গেলে চলবে না।
যথেষ্ট ঘুম, সুষম খাবার, পর্যাপ্ত পানি ও মানসিক শান্তিই পারে আপনার মস্তিষ্কের কুয়াশা সরাতে।

নিজের প্রতি একটু সময় দিন, মনকে বিশ্রাম দিন—দেখবেন, চিন্তা আবার হবে স্বচ্ছ, মন হবে হালকা, আর আপনি ফিরে পাবেন আপনার আসল মানসিক স্বচ্ছতা ও মনোযোগের আলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *