অতিরিক্ত প্রোটিন: স্বাস্থ্য সচেতনতার ছদ্মবেশে বিপদের সঙ্কেত
এক সময় মানুষ খাবারের ক্যালরি, ফ্যাট বা ভিটামিনের হিসাব রাখতেন। এখন সেই জায়গা দখল করেছে একটি শব্দ—প্রোটিন।
ফেসবুক থেকে ইউটিউব, এমনকি মুদি দোকানের তাকেও এখন প্রোটিনের জয়জয়কার।
“হাই প্রোটিন”, “প্রোটিন শেক”, “প্রোটিন স্ন্যাকস”—সব জায়গাতেই বিজ্ঞাপনের দাপট।
অনেকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রোটিন শেক পান করেন, আবার কেউ বলেন—“প্রোটিন ছাড়া মাংস গঠনে হয় না।”
কিন্তু সত্যিই কি আমাদের এত প্রোটিনের প্রয়োজন? নাকি আমরা নিজের অজান্তেই শরীরের ভেতরে জমাচ্ছি নতুন বিপদ?
প্রোটিন—আমাদের শরীরের মৌলিক উপাদান
প্রোটিন শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা ‘প্রোটিওস’ থেকে, যার অর্থ “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ”।
এটি শরীরের প্রতিটি কোষে উপস্থিত এবং অ্যামিনো অ্যাসিড নামক উপাদানে গঠিত।
এই অ্যামিনো অ্যাসিডই কোষের গঠন, টিস্যু মেরামত, হরমোন ও এনজাইম তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একটি সাধারণ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রায় ১৬–১৮ শতাংশ ওজনই প্রোটিন দিয়ে তৈরি।
তবে শরীর এই প্রোটিন মজুদ করে রাখতে পারে না। অর্থাৎ প্রতিদিনের খাদ্য থেকেই এটি সরবরাহ করতে হয়।
যদি প্রোটিন কম খাওয়া হয়, পেশি দুর্বল হয়, চুল পড়ে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়।
তাই প্রোটিন যেমন অপরিহার্য, তেমনি তার সঠিক পরিমাণ জানা জরুরি।
কতটা প্রোটিন যথেষ্ট?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন।
এই পরিমাণ সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে—
৬০ কেজি ওজনের একজন মানুষের দরকার ৪৮ গ্রাম,
আর ৮০ কেজি ওজনের একজন মানুষের দরকার ৬৪ গ্রাম প্রোটিন।
এই প্রোটিন আপনি সহজেই পেতে পারেন দিনে তিন বেলা খাবারে—
একটি ডিমে থাকে প্রায় ৬ গ্রাম,
এক কাপ দুধে থাকে ৮ গ্রাম,
এক কাপ মসুর ডালে থাকে প্রায় ১৫ গ্রাম,
আর এক টুকরো মাছ বা মাংসে থাকে ২০–২৫ গ্রাম প্রোটিন।
অর্থাৎ, আমরা অনেকেই প্রতিদিন খাবার থেকেই পর্যাপ্ত প্রোটিন পেয়ে যাচ্ছি।
তবুও অনেকে মনে করেন—“বেশি প্রোটিন মানে বেশি পেশি।”
এই ভুল ধারণাই বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করছে।
প্রোটিন অতিরিক্ত খেলে কী ঘটে শরীরে?
প্রোটিন ভাঙার সময় শরীরে উৎপন্ন হয় ইউরিয়া, অ্যামোনিয়া ও ক্রিয়াটিনিন—যা প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ করলে এই বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা কিডনির ওপর চাপ ফেলে।
কিডনির ক্ষতি
অতিরিক্ত প্রোটিনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি ঘটে কিডনিতে।
বিশেষ করে প্রাণীজ প্রোটিন (মাংস, ডিম, চিজ) বেশি খেলে কিডনি সেই বর্জ্য প্রসেস করতে হিমশিম খায়।
দীর্ঘমেয়াদে এটি কিডনি ফাংশন কমিয়ে দেয় এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD)-এর ঝুঁকি বাড়ায়।
যাঁদের কিডনি আগে থেকেই দুর্বল, তাঁদের জন্য অতিরিক্ত প্রোটিন হতে পারে মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
লিভারের ওপর প্রভাব
প্রোটিন বিপাক প্রক্রিয়া লিভারের মধ্য দিয়েই ঘটে।
অতিরিক্ত প্রোটিন মানে লিভারের কাজের চাপ বাড়ানো।
ফলে ক্লান্তি, হজমে সমস্যা, এমনকি লিভার এনজাইম বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পানিশূন্যতা
প্রোটিন ভাঙতে প্রচুর পানি লাগে।
ফলে যারা বেশি প্রোটিন খান কিন্তু পর্যাপ্ত পানি পান করেন না, তাঁদের শরীরে ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়।
এর ফলে মাথাব্যথা, শুষ্ক ত্বক, পেশির ক্র্যাম্প হতে পারে।
ওজন বৃদ্ধি
অনেকে ভাবেন প্রোটিন খেলে ওজন কমে, কিন্তু তা সব সময় ঠিক নয়।
অতিরিক্ত প্রোটিন থেকে আসা বাড়তি ক্যালরি যদি ব্যবহার না হয়, তা শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হয়।
ফলে শরীর ভারী হয়ে যায়, মেটাবলিজম ব্যাহত হয়।
প্রোটিন পয়জনিং বা “র্যাবিট স্টার্ভেশন”
এটি একটি বিরল কিন্তু বিপজ্জনক অবস্থা, যা দেখা যায় যখন কেউ প্রচুর প্রোটিন খান কিন্তু ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট খান না।
শরীরে তখন শক্তির ঘাটতি তৈরি হয়, লিভার অতিরিক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড প্রক্রিয়া করতে গিয়ে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া তৈরি করে।
ফলে বমি, মাথা ঘোরা, রক্তচাপ কমে যাওয়া এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
প্রাণীজ বনাম উদ্ভিজ্জ প্রোটিন: কোনটা ভালো?
সব প্রোটিন এক নয়। উৎসের ভিন্নতা এর প্রভাবেও পার্থক্য আনে।
প্রাণীজ প্রোটিন
মাংস, মাছ, ডিম, দুধ থেকে পাওয়া প্রোটিনকে “কমপ্লিট প্রোটিন” বলা হয়, কারণ এতে সব অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে।
তবে এদের সঙ্গে থাকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল, যা হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত লাল মাংস বা প্রক্রিয়াজাত মাংস (সসেজ, বেকন ইত্যাদি) খান, তাদের মধ্যে অকালমৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ২০–৩০% বেশি।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিন
ডাল, মসুর, ছোলা, মটর, বাদাম, বীজ ও সয়াবিনে থাকা প্রোটিনকে বলা হয় উদ্ভিজ্জ প্রোটিন।
এগুলোতে আঁশ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও উপকারী চর্বি থাকে, যা হৃদ্রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিন শরীরে ধীরে হজম হয়, ফলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন—দুই ধরনের প্রোটিনের মধ্যে ভারসাম্য রাখা সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর।
অতিরিক্ত প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি
হৃদ্রোগ: প্রাণীজ প্রোটিনে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ায়, যা ধমনিকে সংকুচিত করে।
ডায়াবেটিস: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি প্রোটিন (বিশেষত মাংস) খাওয়া টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৩০–৫০% পর্যন্ত বাড়াতে পারে।
ক্যানসার: উচ্চ প্রোটিনযুক্ত মাংসজাত খাবার বেশি খেলে কোলন ও প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
হাড় ক্ষয়: অতিরিক্ত প্রোটিন শরীরে অ্যাসিড উৎপাদন বাড়ায়, যা ক্যালসিয়াম ক্ষয় করে হাড় দুর্বল করে দিতে পারে।
প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট: বিজ্ঞাপনের চকচকে ফাঁদ
প্রোটিন পাউডার বা শেক আসলে অনেক সময় “ফাস্ট ফুডের” মতোই।
এগুলোতে থাকে কৃত্রিম সুইটনার, রাসায়নিক সংরক্ষক এবং কিছু ক্ষেত্রে স্টেরয়েডও।
যা অল্প সময়ের মধ্যে ফলাফল দিলেও দীর্ঘমেয়াদে লিভার ও কিডনি নষ্ট করতে পারে।
সাপ্লিমেন্ট কখন ব্যবহার করবেন?
যদি আপনি অ্যাথলেট, বডিবিল্ডার বা কঠিন শারীরিক পরিশ্রম করেন, তখন পুষ্টিবিদের পরামর্শে সীমিত পরিমাণে নিতে পারেন।
সাধারণ মানুষদের জন্য সাপ্লিমেন্ট নয়, প্রাকৃতিক খাবারই সেরা উৎস।