কুষ্টিয়ায় রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড: গভীর রাতে ট্রাকে দাউদাউ করে আগুন

কুষ্টিয়ায় রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড: গভীর রাতে ট্রাকে দাউদাউ করে আগুন

 কুষ্টিয়ায় গভীর রাতে ট্রাকে আগুন: শহরজুড়ে আতঙ্ক, নাশকতার গন্ধ—দুর্বৃত্তদের কর্মকাণ্ড ঘিরে তদন্তে নতুন দৃষ্টিকোণ

কুষ্টিয়া শহরের আড়ুয়াপাড়া এলাকায় গভীর রাতে একটি ট্রাকে আগুন দেওয়ার ঘটনা শহরজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পণ্যবাহী ট্রাকের পেছনের চাকায় আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। রবিবার সকালে ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তেই বিষয়টি কেবল একটি আগুনের ঘটনা না থেকে বিশ্লেষণের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। নিরাপত্তা, রাজনীতি, স্থানীয় অপরাধচক্র—সব দিকই উঠে আসে আলোচনায়।

প্রায় ৫১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়—দুই যুবক রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে মোটরসাইকেল থেকে নেমে আসে। তাদের হাঁটার ভঙ্গি, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শরীরী ভাষা, আগুন ধরানোর পদ্ধতি—সবই নির্দেশ করে ঘটনাটি ছিল সুপরিকল্পিত। তাঁদের একজনের মাথায় হেলমেট, অন্যজনের মুখ আংশিক দেখা গেলেও স্পষ্ট নয়। আগুন লাগানোর পর তাঁদের একজনকে “জয় বাংলা” স্লোগান দিতে শোনা যায়—যা ঘটনাটিকে আরও বিতর্কিত ও সংবেদনশীল করে তুলেছে।

 মুহূর্তের মধ্যে আগুন, কিন্তু অল্পের জন্য রক্ষা—চালক ও সহকারীর বর্ণনা

ট্রাকের চালক রফিকুল ইসলাম জানালেন—সেদিন রাতটা তাদের জন্য ছিল স্বাভাবিক। সপ্তাহজুড়ে পণ্য পরিবহনের কাজ শেষে শহরে এসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে কেবিনে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি ও তাঁর সহকারী জামাল হোসেন।

রফিকুল বলেন—
“ধোঁয়ার একটা তীব্র গন্ধে ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ভাবলাম হয়তো পাশের কোথাও কিছু পুড়ছে। কিন্তু কেবিনের তাপ বেড়ে উঠছিল। দরজা খুলতেই দেখি পেছনে আগুন।”

সহকারী জামালের গলায় তখনও ভয়—
“চাকা জ্বলে উঠলে কিছুই করার থাকত না। একটু দেরি হলে গাড়ির ডিজেল ট্যাঙ্কে আগুন ধরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতো।”

তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে কেবিন থেকে নেমে আসে এবং সঙ্গে থাকা পানি ও মাটি দিয়ে চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। রাতের সুনসান পরিবেশে তাঁদের চিৎকার শুনে আশপাশের কয়েকজন দৌড়ে এসে সাহায্য করেন। বড় ক্ষতি থেকে বাঁচানো হলেও ঘটনাটির ধাক্কা তাঁদের থেকে যায় গভীরভাবে।

 ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে উঠে আসছে ভয়ংকর কিছু ইঙ্গিত

পুলিশ ভিডিওটি সংগ্রহ করে কয়েকবার ধীরগতিতে বিশ্লেষণ করেছে। ফুটেজে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে নজরে এসেছে—

দুজন দুর্বৃত্তের চলাফেরা অত্যন্ত ‘পেশাদার’ ধরনের

তারা ৫–৭ সেকেন্ডের মধ্যেই কাজ সেরে স্থান ত্যাগ করেছে। আগুন ধরানোর পদ্ধতিও ‘পরিচিত অপরাধশিল্পীর’ মতো।

আগুন ধরানোর জন্য ব্যবহৃত পদার্থ ছিল দ্রুত দাহ্য

ফুটেজে দেখা যায়—তারা একটি বোতলজাত তরল চাকায় ছড়িয়ে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে লাইটার বা কোনো ইগনিশন ব্যবহার করে আগুন ধরিয়ে দেয়।

 ঘটনার পরপরই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান

যা জনমতে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
অনেকে বলছেন—এটি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কৌশল হতে পারে।
আবার কেউ কেউ মনে করছেন—এটি রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়ানোর পরিকল্পিত চেষ্টা।

আশপাশে কোনো মানুষ ছিল না—এর মানে কি এলাকা আগে থেকেই ‘পর্যবেক্ষণ’ করেছিল?

এটি তদন্তকারীদের ভাবিয়ে তুলেছে।

পুলিশের তদন্ত: তিনটি আলাদা মোটিভ সামনে এনে কাজ চলছে

কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি মোশারফ হোসেন বলেন—
“এই ঘটনাকে আমরা মোটেও ছোট করে দেখছি না। ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা গেছে ঘটনা অতি শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ঘটানো হয়েছে। এটি সাধারণ দুষ্টুমি বা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়।”

পুলিশ তিনটি মোটিভ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে—

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সৃষ্ট নাশকতা

স্লোগান, ভিডিও, সময়—সবই রাজনৈতিক নাশকতার ছাপ বহন করে।

চাঁদাবাজ বা অপরাধচক্রের ভয় দেখানো

স্থানীয় পরিবহন খাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংঘাত চলছে।
অপরাধীচক্র মাঝে মাঝে ভয় দেখানোর জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটায়।

ব্যক্তিগত শত্রুতা বা ব্যবসায়িক বিরোধ

ট্রাকটি কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।

ওসি বলেন—
“আমরা আশপাশের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছি। মোটরসাইকেলের নম্বর, পোশাকের ধরন, দেহের গঠন—সব বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা—মানুষ বলছে ‘এই শহর কি আর নিরাপদ?’

ভিডিওটি ছড়িয়ে যাওয়ার পর মানুষ নানা মন্তব্য করছেন—

একজন লিখেছেন—
“গভীর রাতে গাড়িতে আগুন! তাহলে রাতের কর্মীদের জীবন তো ঝুঁকিতে!”

আরেকজন মন্তব্য করেছেন—
“আগুন দেয়ার পর স্লোগান—এটার পেছনে আরও কিছু আছে।”

একজন পরিবহন শ্রমিকের পোস্ট—
“এভাবে যদি ট্রাকে আগুন দেওয়া যায়, কাল বাসেও দিতে পারে!”

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক: ‘আমরা রাতের সড়কে আর নিরাপদ নই’

পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি বলেন—
“এটা চরম উদ্বেগজনক। রাতের সড়কে গাড়ি দাঁড় করানো তো সাধারণ বিষয়। এখন বুঝি সেটাও নিরাপদ নয়।”

তাঁদের দাবি—
রাস্তায় বাড়তি পুলিশ টহল
ট্রাক টার্মিনালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা
রাতের বেলায় সন্দেহজনক মোটরসাইকেল নজরদারি
দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তার

 কুষ্টিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে একই ধরনের নাশকতার প্রবণতা?

গত কয়েক মাসে কুষ্টিয়ায় কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে—

রাতে মোটরসাইকেলচালীদের বেপরোয়া চলাফেরা

দোকানে আগুন দেওয়ার চেষ্টা

সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাঁচ ভাঙা

যদিও এসব ঘটনা ছোট পর্যায়ে ছিল, তবে সাম্প্রতিক এই ট্রাক আগুন ঘটনায় সন্দেহ জন্মেছে—
এগুলো কি কোনো বড় চক্রের পরিকল্পিত কার্যক্রমের অংশ?

ঘটনাস্থলের বিশ্লেষণ: কেন এই জায়গা বেছে নেওয়া হতে পারে?

আড়ুয়াপাড়া এলাকায়—
গভীর রাতে লোকজন কম থাকে
যান চলাচল প্রায় নেই
রাস্তার পাশে ট্রাক দাঁড়ানো থাকে
অন্ধকার বেশি, লাইট কম

এমন পরিবেশ নাশকতাকারীদের জন্য সুবিধাজনক।

সামনের পদক্ষেপ: পুলিশ কী করবে?

ওসি জানিয়েছেন—
ভিডিও ফুটেজ ফ্রেম বাই ফ্রেম বিশ্লেষণ
মোটরসাইকেলের ধরন শনাক্ত
আশপাশের দোকান ও বাড়ির ক্যামেরা সংগ্রহ
এলাকায় সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি
ঘটনার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত টিম গঠন

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক
শিগগিরই মামলা দায়ের

উপসংহার: ছোট ঘটনা নয়—এটি নিরাপত্তা, রাজনীতি ও অপরাধজগত তিন দিকেরই সংকেত

কুষ্টিয়ার এ ঘটনা শুধু একটি ট্রাক আগুন নয়—
এটি শহরের নিরাপত্তাচিত্র নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অপরাধচক্রের উত্থান কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতার গণতদন্ত—সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এখন দেখার বিষয়—
ভিডিওতে দেখা দুই যুবক কে? কেন আগুন দিল? কে তাদের পাঠালো?

তদন্ত এগোলেই হয়তো বেরিয়ে আসবে আরও চমকপ্রদ তথ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *