কর্মক্ষেত্রে ডায়াবেটিস: আধুনিক জীবনযাত্রার নীরব মহামারি ও কর্মজীবীদের চ্যালেঞ্জ
ডায়াবেটিস আজ বিশ্বজুড়ে অন্যতম দ্রুত বিস্তার লাভ করা অসংক্রামক রোগ। কয়েক দশক আগে যেখানে ডায়াবেটিস ছিল মূলত মধ্যবয়সী মানুষের সমস্যা, এখন তা ২৫–৪৫ বছরের কর্মক্ষম তরুণ–তরুণীদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের কর্মজীবীরা বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন—কারণ তাঁদের জীবনধারা, কর্মপরিবেশ, কাজের চাপ, অনিয়মিত ঘুম–খাবার, মানসিক চাপ ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা মিলেই ডায়াবেটিসের জন্য একটি ‘পারফেক্ট স্টর্ম’ তৈরি করে।
বাংলাদেশের বাস্তবতাও একই—শহুরে জীবন, অফিসকালচার, ট্রাফিক জ্যাম, রাতে দেরি করে কাজ করা, এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস কর্মজীবীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার বাড়িয়ে তুলছে।
ফলে “কর্মক্ষেত্রে ডায়াবেটিস” এখন কেবল চিকিৎসাবিষয়ক সমস্যা নয়; এটি অর্থনীতি, উৎপাদনশীলতা এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি বড় ইস্যু।
কেন কর্মজীবীরা ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত?
ডায়াবেটিস বাড়ার পেছনে বহু কারণ রয়েছে, তবে কর্মজীবী মানুষের ক্ষেত্রে যে কারণগুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, তা গভীরভাবে নিচে ব্যাখ্যা করা হলো—
দীর্ঘ সময় বসে থাকার ঝুঁকি (Sedentary Work Culture)
বেশিরভাগ চাকরিজীবী দিনে ৮–১০ ঘণ্টা এক জায়গায় বসে কাটান।
বসে থাকার সময় রক্তসঞ্চালন কমে যায়
ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে
পেশি কম কাজ করে, ফলে গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয় না
ডেস্ক জব কর্মীদের মধ্যে টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৩০–৬০% বেশি।
এমনকি ব্যায়াম করলেও দীর্ঘসময় বসে থাকা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায় না—এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও অনিয়মিত খাবার
কর্মজীবীরা প্রতিদিন যে অভ্যাসগুলো করেন, সেগুলোই ডায়াবেটিস বাড়ানোর ‘ডাবল ট্রিগার’—
সকালের নাস্তা না খেয়ে অফিসে যাওয়া
ক্যানটিন থেকে ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া
চা–কফির সঙ্গে অতিরিক্ত চিনি
কাজের চাপের কারণে অদ্ভুত সময়ে খাবার খাওয়া
লাঞ্চের পরপরই বসে কাজ করা
জাঙ্কফুড বা ফাস্টফুডের ওপর নির্ভরশীলতা
এসব অভ্যাস ধীরে ধীরে শরীরের ইনসুলিন প্রতিরোধ বাড়িয়ে দেয়।
মানসিক চাপ, স্ট্রেস ও ডেডলাইন সংস্কৃতি
অফিসের টার্গেট, প্রতিযোগিতা, কাজের চাপ—এসব কারণে শরীরে কর্টিসল বাড়ে।
কর্টিসল বাড়লে—
রক্তে শর্করা বেড়ে যায়
ক্ষুধা বাড়ে
ঘুম কমে
ওজন বাড়ে
এগুলো আবার ডায়াবেটিসকে ত্বরান্বিত করে।
অর্থাৎ স্ট্রেস = সরাসরি ডায়াবেটিস ঝুঁকি।
ঘুমের ঘাটতি
কাজের চাপ, অনিয়মিত সময়সূচি, মোবাইল ব্যবহার—এসবের কারণে কর্মজীবীরা পর্যাপ্ত ঘুম পান না।
কম ঘুমে যা হয়—
গ্লুকোজ কাজ করে কম
ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমে
শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়
স্ট্রেস বাড়ে
এই চারটি কারণই সরাসরি ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
শহুরে কর্মজীবীরা কম হাঁটেন।
গাড়ি বা রাইড শেয়ার
লিফট
ডেস্ক জব
এসব মিলেই দৈনিক হাঁটার পরিমাণ কমে যায়।
প্রতিদিন কমপক্ষে ৮,০০০–১০,০০০ পদক্ষেপ বা ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা না হলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক বাড়ে।
চিকিৎসা নেওয়ায় লজ্জা বা সংকোচ
অনেক ডায়াবেটিস রোগী—
অফিসে ইনসুলিন নিতে লজ্জা পান
সহকর্মীদের কাছে রোগ প্রকাশ করতে চান না
নিয়মিত ওষুধ নিতে ভুলে যান
খাবারের সময় ঠিক রাখতে পারেন না
ফলে রোগ দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
কর্মক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের প্রভাব — ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতি পর্যন্ত
ডায়াবেটিসের প্রভাব শুধু ব্যক্তির ওপর পড়ে না; এটি কর্মক্ষেত্রকেও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ করে।
শারীরিক ও মানসিক সমস্যার বৃদ্ধি
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কর্মীরা প্রায়ই অনুভব করেন—
ক্লান্তি
চোখ ঝাপসা দেখা
মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা
মাথা ঘোরা
বারবার বাথরুমে যেতে হওয়া
এগুলো উৎপাদনশীলতা কমায়।
উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া
একে বলা হয়—
Presenteeism → অফিসে উপস্থিত থেকেও পুরোপুরি কাজ করতে না পারা।
একজন ডায়াবেটিস রোগীর গড় উৎপাদনশীলতা ২০–৩০% কমে যায়।
অনুপস্থিতির হার বৃদ্ধি
চিকিৎসা, অসুস্থতা, চেকআপ—এসব কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা বছরে বেশি দিন ছুটি নেন।
একে বলা হয়—
Absenteeism → নিয়মিত ছুটি।
প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ক্ষতি
গবেষণা বলছে—
ডায়াবেটিস আক্রান্ত কর্মীর চিকিৎসা ব্যয় স্বাস্থ্যবান কর্মীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ
দীর্ঘমেয়াদে হার্ট, কিডনি, চোখের সমস্যা হলে ব্যয় আরও বেড়ে যায়
উৎপাদনশীলতা কমে গেলে প্রতিষ্ঠান ঘাটতিতে পড়ে
বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের কারণে শত শত বিলিয়ন ডলার উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়।
কীভাবে কর্মক্ষেত্র হবে ডায়াবেটিসবান্ধব?
একটি প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা এভাবে সাজালে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়—
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা
প্রতিষ্ঠানে প্রতি ৬ মাস বা বছর অন্তর—
ব্লাড সুগার
ব্লাড প্রেসার
ওজন ও BMI
কোলেস্টেরল
চোখের পরীক্ষা
এসব করালে কর্মীরা দ্রুত ঝুঁকি শনাক্ত করতে পারেন।
অফিসে শরীরচর্চার সুযোগ
স্ট্যান্ডিং ডেস্ক
প্রতি ঘণ্টায় ৩-৫ মিনিট হাঁটার নিয়ম
লাঞ্চের পর ১৫ মিনিট হাঁটা
সিঁড়ি ব্যবহারের উৎসাহ
অফিসে ছোট জিম বা ফিটনেস কর্নার
এসব ব্যবস্থায় কর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই সক্রিয় থাকেন।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য সরবরাহ
অফিস ক্যানটিনে—
কম তেলে রান্না
চিনি ছাড়া পানীয়
সালাদ, ওটস, ফল
কম ভাজা খাবার
উপস্থিত থাকা উচিত।
পানি ও হাইড্রেশন নিশ্চিত করা
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে পানি খুব জরুরি।
অফিসে সহজে পানি পাওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
ডায়াবেটিস সচেতনতা কর্মসূচি
সেমিনার
পোস্টার
পরামর্শ সেবা
জরুরি অবস্থায় করণীয় শেখানো
এগুলো কর্মীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
কাউন্সেলিং সেশন
মাইন্ডফুলনেস
সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট
স্ট্রেস কমলে ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ইনসুলিন বা ওষুধ নেওয়ার ব্যক্তিগত স্থান
ডায়াবেটিস রোগীরা যেন সংকোচ ছাড়াই—
ওষুধ নিতে
ইনসুলিন নিতে
রক্ত পরীক্ষা করতে
পারেন, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সহানুভূতিশীল কর্মপরিবেশ — একটি প্রতিষ্ঠানের মানবিক দায়িত্ব
ডায়াবেটিস রোগী কর্মীর জন্য ছোট একটি সুবিধা প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদে বিশাল লাভ দিতে পারে।
খাবারের নির্দিষ্ট সময় দেওয়া
অতিরিক্ত বিরতি দেওয়ার সুযোগ
চিকিৎসার জন্য সময় দেওয়া
সহকর্মীদের সহযোগিতা
এসব পদক্ষেপ কর্মীকে প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বস্ত করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
কর্মীর নিজের করণীয় — ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের আটটি নিয়ম
তিন বেলা নিয়মিত খাবার
প্রতিদিন ৩০–৪৫ মিনিট হাঁটা
চিনি কমানো
পর্যাপ্ত পানি পান
স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ
সময়মতো ওষুধ/ইনসুলিন
পর্যাপ্ত ঘুম
নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা
এগুলো প্রতিদিন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
শেষ কথা: সুস্থ কর্মী মানেই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান
ডায়াবেটিসকে উপেক্ষা করা যাবে না।
এটি কর্মীর—
স্বাস্থ্য
মানসিক শক্তি
উৎপাদনশীলতা
আর্থিক নিরাপত্তা
সবকিছুতেই প্রভাব ফেলে।
একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের—
কর্মক্ষমতা
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
মানবসম্পদ উন্নয়ন
এগুলোতেও সরাসরি প্রভাব পড়ে।
একটি ডায়াবেটিস-বান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি করলে কর্মী সুস্থ থাকে, প্রতিষ্ঠানও শক্তিশালী হয়।