খেলার মাঝেই কম্পনের আতঙ্ক

মিরপুর স্টেডিয়ামে ভূমিকম্পের সকাল: ক্রিকেট, শঙ্কা, ভীতিকর কয়েক সেকেন্ড এবং ম্যাচের মোড় ঘোরানো নাটকীয় এক দিন

মিরপুর স্টেডিয়ামে ভূমিকম্পের সকাল: ক্রিকেট, শঙ্কা, ভীতিকর কয়েক সেকেন্ড এবং ম্যাচের মোড় ঘোরানো নাটকীয় এক দিন

ঢাকার মিরপুর এলাকা—যা বাংলাদেশের ক্রিকেটের হৃদয় বলে পরিচিত—সেদিন সকালেও ছিল তার স্বাভাবিক রূপে। শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম তখন ধীরে ধীরে তার দৈনন্দিন ক্রিকেট–জীবন লাভ করছে।
গ্যালারির সিঁড়িগুলোতে পা পড়ছে প্রথম সারির দর্শকদের, মাঠে কর্মীরা শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত, আর বাইরের ফটক দিয়ে ভিড় করে ঢুকছে ক্রিকেট–প্রেমীরা।

বাংলাদেশ ও আয়ারল্যান্ডের ম্যাচ।
যদিও এটি ছিল সাধারণ একটি ওয়ানডে ম্যাচ, তবুও শেরেবাংলায় প্রতিটি ম্যাচই একটি উৎসব।

কিন্তু সেদিনের সকালটি খুব সাধারণভাবে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় অপ্রত্যাশিত, আলোচিত, এবং ভবিষ্যতে অনেকবার স্মৃতিতে ফিরে আসার মতো এক দিন।

সকালের প্রথম সেশন: বাংলাদেশের প্রত্যাশা বনাম আয়ারল্যান্ডের প্রতিরোধ

আয়ারল্যান্ডের ইনিংস ৫২ ওভার পেরিয়েছে।
পিচ কিছুটা ধীর, স্যাঁতসেঁতে, বোলারদের সাহায্য করার মতো, কিন্তু সেদিন তা যেন ব্যাটসম্যানদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

স্টিভেন ডোহানি ও লরকান টাকার—দু’জন যেন আগের ম্যাচের হতাশার বদলা নিতে নেমেছেন।
তারা শুধু টিকে ছিল না—বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাংলাদেশি বোলারদের চ্যালেঞ্জ করছিলেন।

মাঠে–মাঠে ছড়িয়ে পড়েছিল অস্থিরতা—

“এ জুটি ভাঙবে কবে?”

“বাংলাদেশের কোনো পরিকল্পনা কাজ করছে না।”

“স্পিন–পেস—সবই চেষ্টা করা হলো, কিন্তু উইকেট আসছে না।”

প্রেসবক্সেও একই আলোচনা।
বোলারদের মনোযোগ কমছে, দর্শকের উত্তেজনা কমছে—ম্যাচ যেন ধীরে ধীরে আয়ারল্যান্ডের দিকে গড়াচ্ছে এমনই একটা পরিস্থিতি।

ঠিক তখনই প্রকৃতি যেন বলল—
“এই খেলা শুধু মানুষের হাতে নয়, আমারও ভূমিকা আছে।”

হঠাৎ কম্পন—প্রথমে হালকা, পরে স্পষ্ট

বেলা প্রায় সাড়ে দশটা।
স্টেডিয়ামের আকাশ পরিষ্কার, মাঠ উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে।
প্রেসবক্সে সাংবাদিকরা স্কোর আপডেট, টুইট, প্রতিবেদনের খসড়া নিয়ে ব্যস্ত।

হঠাৎ—
একটা টেবিল সামান্য দুলে উঠল।

কেউ খেয়াল করল না।
অথবা গুরুত্ব দিল না।

কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই—

চেয়ার, ডেস্ক, কাঁচের জানালা, এমনকি পুরো তলা সামান্য গড়াতে শুরু করল।
মনে হচ্ছিল কেউ যেন বিশাল শক্তি দিয়ে ভবনের নীচতলা থেকে ধাক্কা দিচ্ছে।

প্রথমে ভয় হয়নি—বিভ্রান্তি হয়েছে।
কেউ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করছিল—
“এটা কি ট্রাকের কম্পন?”
“কেউ দৌড়াচ্ছে?”

আর ঠিক সেই মুহূর্তে, কোনো এক সাংবাদিক নিজের কণ্ঠের দমকে চিৎকার করে উঠলেন—
“ভূমিকম্প! সবার নিচে নামুন!”

শব্দটি যেন বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ল।

মুহূর্তেই পুরো প্রেসবক্স উল্টে গেল।
শতাধিক মানুষ, ক্যামেরা–ম্যান সহ, দৌড়াতে শুরু করলেন সিঁড়ির দিকে।

পাঁচতলা প্রেসবক্স থেকে নামার আতঙ্ক

মিরপুর প্রেসবক্সের কাঠামো উঁচু, এবং দোল লাগলে বিষয়টি অনেক বেশি অনুভূত হয়।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অনেকের মনে একই চিন্তা—
“আরেকটা কম্পন এলে কী হবে?”

সাংবাদিকরা বাদে—

কেউ ব্যাগ রেখে এসেছে,

কেউ ফোন নিতে ভুলেছে,

কেউ নোটবুক বন্ধ করতে পারেনি।

সবাই শুধু একটা জিনিসই চাইছিল—নিচে পৌঁছানো।

নিচে এসে দেখা গেল—ভূমিকম্পের প্রভাব শুধু প্রেসবক্সেই নয়, পুরো স্টেডিয়ামেই ছড়িয়ে পড়েছে।

গ্যালারির দর্শকদের ছুটোছুটি

গ্যালারিতে যারা বসে ছিলেন, বিশেষত দোতলা বা ওপরে—
তারা দ্রুত নিচে নামতে শুরু করেন।

মায়েরা বাচ্চাদের হাত ধরে টেনে নামাচ্ছেন

বৃদ্ধ দর্শকদের সহায়তা করছেন নিরাপত্তাকর্মীরা

কেউ ফোনে খবর জানতে চাইছেন

আবার কেউ শুধু দৌড়াচ্ছেন আতঙ্কে

স্টেডিয়ামের গ্যালারি—যা সাধারণত উল্লাসে, স্লোগানে, হইচইয়ে ভরা থাকে—সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র হয়ে দাঁড়াল।

মাঠে থাকা ক্রিকেটারদের অবস্থা—মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ

ক্রিকেটাররা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে—
তাদের শরীর তেমন দুলনি অনুভব করেনি, কারণ মাঠ খোলা।
কিন্তু গ্যালারির অস্থিরতা দেখে বুঝতে সময় লাগল না—কিছু একটা ঘটেছে।

আয়ারল্যান্ড দল একসঙ্গে জড়ো হয়ে গেল—এটাই জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের নিয়মিত প্র্যাকটিসড পজিশন।
বাংলাদেশ দলও পিচের মাঝখানে এসে আলোচনা করছে—কিছুটা উদ্বেগ, কিছুটা প্রশ্ন, কিছুটা অস্বস্তি।

কোচ ফিল সিমন্স বলেন—
“আমাদের ড্রেসিংরুমেও স্পষ্ট শোরগোল, কম্পন অনুভব করেছি। প্রথমে বুঝতেই পারিনি কী হচ্ছে।”

ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খান পরে বলেন—
“যখন জানলাম ভূমিকম্প হচ্ছে, দৌড় ছাড়া আর কিছু মাথায় আসেনি।”

খেলা বন্ধ—মাত্র তিন মিনিট, কিন্তু মনে রাখার মতো একটা সময়

১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
খেলা সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায়।
অ্যাম্পায়াররা নির্দেশ দেন—সবাই নিরাপদে থাকুক।

এই বিরতি ঠিক ৩ মিনিট।
কিন্তু সেই ৩ মিনিট—
স্টেডিয়ামের হাজারো মানুষের জন্য যেন ঘণ্টার মতো দীর্ঘ হয়ে ওঠে।

দর্শকদের ভিড়, শঙ্কা, আলোচনার শব্দ—সবকিছু মিলিয়ে স্টেডিয়াম ঐ মুহূর্তে এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার জায়গায় ছিল।

ভূমিকম্পের পরে নাটকীয়ভাবে ম্যাচের মোড় ঘোরানো

ম্যাচ আবার শুরু হলো।
প্রথম এক–দুই বলের পরই বোঝা গেল—বাংলাদেশের বোলাররা পুরোনো হতাশা ঝেড়ে অন্য রকম মনোভাব নিয়ে ফিরেছেন।

তাইজুল ইসলাম বল হাতে নিলেন—
আর যেন আয়ারল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের জন্য বিরতিটাই কাল হয়ে দাঁড়াল।

মাত্র তিন বলের ব্যবধানে তিনি তুলে নিলেন দুই ব্যাটসম্যানের উইকেট।
যে ডোহানি–টেক্টর–টাকার জুটি এতক্ষণ বাংলাদেশের মাথাব্যথা ছিল, তা হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ল।

দর্শকেরা উচ্চস্বরে চিৎকার করলেন—
“বাংলাদেশ ফিরে এসেছে!”

কেউ মজা করছিলেন—
“ভূমিকম্প বোধহয় বোলারদের জাগিয়ে দিয়েছে!”

স্টেডিয়াম ফের স্বাভাবিক—কিন্তু আলোচনায় একটাই বিষয়

বিরতির পর ম্যাচ জমে গেল।
কিন্তু সেদিনের সব আড্ডা, মন্তব্য, মিডিয়ার প্রশ্ন—সব জায়গায় একটাই আলোচনার বিষয় ছিল—

মিরপুর স্টেডিয়ামে ভূমিকম্প।

অনেকে বলছিলেন—
“এত দর্শক নিয়ে যদি বড় কম্পন হতো?”
“সিঁড়িগুলো খুব চাপ সামলাতে পারতো তো?”
“স্টেডিয়াম কি ভূমিকম্প-প্রতিরোধী?”

এমনকি ম্যাচ শেষে খেলোয়াড়দের মধ্যেও আলোচনা চলছিল ঘটনাটি নিয়ে।

একটি সকাল, কয়েক সেকেন্ড—কিন্তু মিরপুরের ইতিহাসে স্থায়ী স্মৃতি

বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক ঘটনা ঘটেছে—
অসাধারণ জয়, হতাশার হার, ঝড়–বৃষ্টি, আলো নষ্ট হওয়া, পিচ ভেঙে যাওয়া…

কিন্তু খেলার মাঝখানে ভূমিকম্প?

খুব কম ম্যাচেই এমন নাটকীয় ঘটনা ঘটে।
সেদিন প্রকৃতি বুঝিয়ে দিল—
“মাঠের নিয়ন্ত্রণ সবসময় মানুষের হাতে থাকে না।”

মিরপুর স্টেডিয়ামের সেই দিনটি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে—
শুধু খেলার জন্য নয়,
ভয়, অস্থিরতা, এবং নাটকীয় গল্পের জন্যও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *